বাংলাদেশে সকল ধর্মের সমান স্বাধীনতা ও মুসলিমদের উদার মানসিকতা বিশ্বের কাছে প্রসংশিত। যেখানে সকল স¤প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে যুগ যুগ ধরে শান্তিতে বসবাস করছে। হিন্দু স¤প্রদায়ের দুর্গা প‚জা, রথযাত্রা ও খৃস্টানদের বড়দিন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ প‚র্ণিমাসহ সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাই প্রমাণ করে সংখ্যালঘুদের জন্য রাষ্ট্র কতটা তৎপর। চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এতোটা আন্তরিকতার নজির খুব কমই রয়েছে।
মার্কিন প্রশাসনে প্রিয়া সাহা’র বাংলাদেশ বিরোধী নালিশ আমাদের শুধু বিচলিতই করেনি; দেশবিধ্বংসী উইপোকারা যে ধেয়ে আসছে তাও মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রিয়া সাহা’রা নব্য সংখ্যালঘু রাজাকারের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন- এটা নিশ্চিত। বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের জন্য স্বর্গ, ক্ষেত্রবিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরাই তথাকথিত সা¤প্রদায়িকতার শিকার। পান থেকে চুন খসলেই ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার নামে মুসলিমদের উপর অভিযোগের আঙ্গুল উঠে, তব্ওু বাংলাদেশের মুসলিম স¤প্রদায় সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতাই দেখায়। অথচ পার্শবর্তী ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের হামলায় বাবরী মসজিদ ধ্বংসসহ স¤প্রতি জয় শ্রীরাম শ্লোগানে মুসলিম নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসী জানে।
প্রিয়া সাহা’র নালিশকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ইস্যুটি নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থান ও আইনী পদক্ষেপ না নিলেও বিশ্ব মোড়লরা বসে থাকবেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে দেয়া প্রিয়া সাহা’র বক্তব্যকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ নয় এবং ছোট্ট ঘটনা’ বলে যে মন্তব্য করেছেন তা আগুনে কেরোসিন ঢেলে দেয়া ছাড়া কিছু নয়। গত সপ্তাহে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিচারকদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে ট্রাম্পকে যে তথ্যগুলো প্রিয়া সাহা দিয়েছেন তা সর্বৈব মিথ্যা, বিএনপি-জামায়াতের সময় ছাড়া বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এটা তার ব্যক্তিগত ঈর্ষা চরিতার্থের জন্য করেছে। এত ছোট্ট ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে গেছে- তা মনে করি না’। মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জাতির প্রশ্ন- আর কতো বড় নালিশ দিলে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বলে গণ্য করবেন? সবকিছুতে রাজনৈতিক ফায়দা বা জামায়াত-বিএনপি ইস্যু খোঁজা শুভকর নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেয়া প্রিয়া সাহা’র তথ্যানুযায়ী ‘বাংলাদেশে ৩৭ মিলিয়ন অর্থাৎ তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টানকে গুম বা হত্যা (ডিজএপিয়ার) করা হয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালানো ও জমি-জমা সব দখল করা হয়েছে। এছাড়া আরো এক কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু নিরাপত্তাহীন। আর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব করছে মুসলিম মৌলবাদীরা’। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র উদ্যোগে ওয়াশিংটন ডিসিতে গত ১৭ জুলাই থেকে তিনদিন ব্যাপী ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষে হোয়াইট হাউসে ১৬টি দেশের ২৭জন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকে প্রিয়া সাহা এসব অভিযোগ করেন। আমার প্রশ্ন- হোয়াইট হাউসের মতো স্থানে প্রিয়া সাহা আমন্ত্রণের সুযোগ পেলো কিভাবে? প‚র্বপরিকল্পনা কিংবা গভীর লবিং ছাড়া তার প্রবেশ সম্ভব হয়নি নিশ্চয়ই! বিশ্ব মোড়লের কাছে নালিশের বিষয়বস্তু আগে থেকে না জেনে কিংবা যথেষ্ট যাচাই-বাছাই না করেই তাঁকে হাজির করা হয়েছে- এমনটা ভাববার সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে তাঁর সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক অবস্থানও স্পস্ট নয়। অথচ প্রিয়া সাহা উক্ত সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সম্প্রতি বহিষ্কৃত। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত একাত্তর টিভিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে যে কথা বলেছেন, তাতে সংগঠন থেকে তিনজন প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে পাঠানো হয়েছিলো, যেখানে প্রিয়া সাহা ছিলেন না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি হিন্দু সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ওই সম্মেলনে যান এবং ট্রাম্পের সাথে কথা বলেন। এখন প্রশ্ন- যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠনটির কী এমন স্বার্থ যে, তারা বাংলাদেশি হিন্দুকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠালো?
বিষয়টি পরিষ্কার, প্রিয়া সাহা’র বক্তব্য তাঁর একান্ত মতামত নয়। তাঁর মুখস্ত কথার উপস্থাপনা ও তাঁর সঙ্গে খোদ ট্রাম্প মহাশয়ের করমর্দন আর সহানুভ‚তির অভিনয়ে এটাই স্পষ্ট যে, বিষয়টি প‚র্বপরিকল্পিত, সাজানো নাটক এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। প্রকাশিত ভিডিও অনুযায়ী, সেখানে উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে হাত মেলানো বা এতোটা আন্তরিকতা ট্রাম্পকে দেখা যায়নি, যা প্রিয়া সাহা’র ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
সরকারকে আহŸান জানাই, বিষয়টি যেনো কোনোভাবেই হালকা করে দেখা না হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘প্রিয়া সাহা দেশে ফিরলে ব্যবস্থা নেয়া হবে’। ফিরলে নয়, তাকেঁ অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। নইলে কোনো অনাকাক্সিক্ষত চড়া মাশুলের দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। কারণ প্রিয়া সাহা’র অভিযোগ খÐানো সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জও বটে! বিশ্বজিতের ঘটনা কিন্তু সরকারদলীয় মুসলিম স¤প্রদায়ের দ্বারাই হয়েছে।
সরকারকে ভেতরের অনেক বিষয়ই খতিয়ে দেখতে হবে। প্রিয়া সাহা বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত ‘শাড়ি’ নামক একটি এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক। সেখান দলিত স¤প্রদায়কে নিয়ে কাজ করার নামে দেশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিম‚লক তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে টাকা আনা হয় কিনা, এনজিও’র মাধ্যমে কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাÐ হয় কিনা- তা খতিয়ে দেখতে হবে। মহিলা ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে কী কী বিতর্কিত কর্মকাÐের জন্য তাকেঁ বহিষ্কার করা হয়েছে- তা জানতে হবে। ‘দলিত কন্ঠ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার তিনি সম্পাদক। পত্রিকার আড়ালে কী হয়- সেটাও ভাববার বিষয়। পিরোজপুরে তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনাটি বিদেশ থেকে টাকা আনার ফন্দি কিনা- সেটাও তদন্ত করতে হবে। পাশাপাশি তাঁর স্বামী দুদকের উপপরিচালক মলয় কুমার সাহা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবহার করে স্ত্রীর সঙ্গে দেশবিরোধী চক্রান্তে জড়িত কিনা- তাও খতিয়ে বের করা জরুরী। কিছুদিন আগে মলয় বাবুর কোটি টাকার গাড়ি ক্রয়ের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, যা তদন্ত করলে জ্ঞাত আয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতা হবে না। তাঁর দুই মেয়ের যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্যয়বহুল দেশে পড়াশোনার খরচ কীভাবে জোগাড় হয়, সেটাও তদন্তের বিষয়। অবশ্যই তদন্ত হতে হবে মলয় সাহাকে স্বপদ থেকে সরিয়ে এবং স্বামী-স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ফটোগ্রাফার শহিদুল ইসলাম বিদেশী গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়ায় তাঁর উপর যে নির্যাতন হয়েছে, রাষ্ট্র তা প্রত্যক্ষ করেছে। শহিদুল ইসলামের বক্তব্য কিংবা অন্য কোনো চক্রান্তকারী গোষ্ঠী অতীতে যা করেছে বা করেনি, প্রিয়া সাহা’র নালিশ সে সবের চেয়ে দেশের বিরুদ্ধে হাজার গুণ ক্ষতিকর। এখন দেখতে চাই, প্রিয়া সাহার প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাÐে সরকার কী করে! আমি এটা বলতে চাই না যে, প্রিয়া সাহা বর্তমান সরকারদলের পৃষ্ঠপোষকতায় চলেন। তবে এটাও অস্বীকার করবো না, তিনি তাঁদের সুনজরের বাইরে ছিলেন। কারণ সরকারের মন্ত্রী, নীতিনির্ধারক ও গুরুত্বপ‚র্ণ নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর নিয়মিত চলাচলের ছবি গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপ‚র্ণ বৈঠকগুলোতে তাঁর অংশগ্রহণ সরব ছিলো। তাঁর সংগঠনও (হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদ) আওয়ামী লীগের আন্তরিকতাই ভোগ করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০ মিলিয়নের উপর সংখ্যালঘু নেই, সেখানে কোন স্বার্থে, কতো টাকার লোভে প্রিয়া সাহা এমন মিথ্যাচার করলেন? তিনি কি জানেন না দেশে প্রায় ৩০ ভাগ সরকারি-বেসরকারী উচ্চপদস্থ বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন সংখ্যালঘুরা? তিনি নিজেই সরকারের মন্ত্রী-এমপি, নীতি নির্ধারকদের সাথে মিশে আছেন, তবে কিভাবে রাজনৈতিক হয়রানীর শিকার হলেন?
ধর্ম হচ্ছে শান্তি, বিশ্বাস, আশ্রয়ের জায়গা। আর এ ধর্মকে হীনস্বার্থে ব্যবহার করে, অন্য ধর্মকে ভুল ব্যাখ্যা করে শুধু রাষ্ট্রদ্রোহীই নয়; রীতিমতো সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে নষ্টের অপচেষ্টা হয়েছে। প্রিয়া সাহা’দের ভাবতে হবে, আমরা বাংলাদেশি মুসলিমরা প‚জা, বড়দিনসহ আপনাদের সকল উৎসবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা করি, পাশে থাকি।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন