পর্যটন নগরী কক্সবাজার। বিশ্বজুড়ে যার পরিচিতি। অথচ প্রকৃতির সেরা উপহার এই শহরের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যেকোনো প্রান্তিক শহরকেও হার মানায়। চলতি বর্ষা মৌসুম চলমান দুরাবস্থাকে বেগ দিয়েছে আরো কয়েকগুণ। ফলে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এবং কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত আরাকান সড়কের বেহাল দশা এখন বর্ণনাতীত। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। স্বাভাবিক কারণেই বিমুখ হচ্ছেন পর্যটকরা।
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারবিহীন ১৫০ কিলোমিটারের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি। প্রতিদিন শত শত যানবাহন এবং হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করলেও সংস্কারে নেই কোনো উদ্যোগ। সাম্প্রতিক বন্যায় সাতকানিয়া-চন্দনাইশের মাঝামাঝি কসাইপাড়া এলাকায় সড়কটি তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। এমনকি ৪৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। শত শত যানবাহন আটকা পড়ে সৃষ্টি হয় ২০ কিলোমিটরের যানজট। এছাড়াও পুরো সড়কটি খানাখন্দে ভর্তি। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার তিন ঘণ্টার রাস্তা হলেও লাগে ৪-৫ ঘণ্টা।
এদিকে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর নাজুক অবস্থা না দেখলে বোঝার উপায় নেই। শহরের প্রধান সড়কসহ অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো এত বিপর্যস্ত যে-যানবাহন দূরের কথা হেঁটে চলাচলই দায়। গত মঙ্গলবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জনপ্রশাসন পদক পাওয়ায় আনন্দ সমাবেশে প্রবীণ রাজনীতিবিদ মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ঘোষণা দেন সওজ অফিস ঘেরাও করার। এছাড়াও তিনি নানা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তুদুই দিন পার হলেও কোনো প্রতিকার পায়নি শহরবাসী। বরং স্থানীয় সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে সড়কটি এখন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে বলে দায় সেরেছেন।
কক্সবাজার-টেকনাফ (শহীদ এটিএম জাফর আলম) সড়কটিও দীর্ঘদিন মেরামত কিংবা সংস্কার হয়নি। ফলে এলাকাবাসী কোটবাজার জনবহুল স্টেশনে ধানের চারা রোপণ করে প্রতিবাদ জানায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সংস্কারে ধীরগতির কারণে যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে জেলার সাধারণ যাত্রীদের। ৫০ কিলোমিটার অংশের সংস্কারকাজ শুরু হলেও গত পাঁচ মাসে ৩০ ভাগ কাজও শেষ হয়নি। সড়ক ও জনপদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানা ১২ দিনের বৃষ্টির কারণে সড়কে থাকা বিটুমিনের আস্তরণ তোলা সম্ভব হয়নি। এ কারণে সড়কের মূল কার্পেটিংয়ের কাজও শুরু করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এরমধ্যে তিনটি পৃথক প্রকল্পের আওতায় ৭৯ কিলোমিটার সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নকাজে ৪৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এই কাজের তত্ত¡াবধান করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত আছেন ২ হাজার বিদেশিসহ অন্তত ১১ হাজার চাকরিজীবী। ফলে ব্যবহার হচ্ছে ২ হাজারের বেশি প্রাইভেট গাড়ি। শিবিরে দৈনিক গড়ে মালামাল পরিবহন হচ্ছে ৪ শতাধিক ট্রাকে। এ ছাড়া টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যে আমদানি-রফতানির ট্রাক, পর্যটকদের গাড়ি, যাত্রীবাহী বাস চলাচল করছে আরও এক হাজারের বেশি। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা, জিপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলে আরও ৭ হাজার। মেরিন ড্রাইভ সড়কে সব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আরাকান সড়কে যানবাহনের ব্যাপক চাপ পড়ায় সড়কটি লÐ ভÐ হয়ে পড়ে।
প্রতিবাদকারীরা অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গা আসার পর থেকে অতিরিক্ত যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় সড়কের কোটবাজার, মরিচ্যা, উখিয়া সদর, কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার সড়কজুড়ে বড় বড় পাঁচ শতাধিক খানাখন্দ তৈরি হয়। প্রায় প্রতিদিন দেশি-বিদেশি ভিআইপিরা এই সড়কে যাতায়াত করলেও উখিয়া-টেকনাফের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।
সওজ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী পিণ্টু চাকমা বলেন, সড়কের দুই পাশে নালা খনন, বৈদ্যুতিক খুঁটি, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, ভ‚গর্ভস্থ টিঅ্যান্ডটি ও ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড লাইন অপসারণ ও মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। সা¤প্রতিক টানা ভারী বর্ষণে সড়কের উন্নয়নকাজ ব্যাহত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে সড়কের ওপরে বিটুমিন তুলে ফেলা সম্ভব হয়নি। বিটুমিন তুলে ফেলার পরই সেখানে পাঁচ ইঞ্চি পুরু কার্পেটিং হবে। আগামী ২০২০ সালের জুনের মধ্যে অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়ে যাবে।
স¤প্রতি কক্সবাজার ভ্রমণে আসা বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ সংবাদদাতা ও ক্রীড়া সম্পাদক রেজাউর রহমান সোহাগ বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে বলেছেন, এটি মারাত্মক বিপর্যয়। এই অবস্থা হলে পর্যটকরা কক্সবাজার বিমুখ হবেন। এ সময় তিনি এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর-এর সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন নামে ধাপ্পাবাজি করছে। নেতারা লুটপাট করে আখের গোছাচ্ছে অথচ জনগণের ভোগান্তির কোন সীমা নেই।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, শহরের এ দুর্দশা আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তবে এ সমস্যা সমাধানের জন্য খুব শিগগিরই উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়াও তিনি জানান, দুঃখজনক হলেও শহরের প্রধান সড়কটি কক্সবাজার পৌরসভার আওতাধীন নয়। সড়কটি সড়ক জনপথ বিভাগের অধীনে থাকলেও এখন সড়কটি সংস্কারে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন