অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান
আয়াতে ব্যবহৃত ‘সম্ভবত’ শব্দটি অত্যন্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ শুধু পানাহার বর্জন করলেই তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব নয়। এর সাথে আরো কিছু নিয়ম-নীতি মানা অপরিহার্য। বিভিন্ন হাদীসে এ নিয়ম-নীতির উল্লেখ আছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, তার শুধু খানাপিনা পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই।” (বোখারী শরীফ)
“অনেক রোযাদার এমন আছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া তাদের ভাগ্যে অন্য কিছুই জোটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদতকারী অনেক মানুষও এমন আছে, যাদের রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না।”
“রোযা ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ কখনো রোযা রাখলে তার মুখ থেকে যেন খারাপ কথা বা গালিগালাজ বের না হয়। কেউ যদি তাকে গাল-মন্দ করে বা ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করে তবে সে যেন বলে, আমি রোযাদার।” (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তিসাবের (আত্মবিশ্লেষণ) সাথে রমযানে রোযা রাখল সে পূর্বকৃত সকল গুনাহ্ মাফ করিয়ে নিল। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তিসাবের সাথে রমযানের দীর্ঘ সালাত (তারাবি) আদায় করলো সে পূর্বকৃত গুনাহ মাফ করিয়ে নিল।” (বোখারী ও মুসলিম)।
মোটকথা, আত্মসংযম ও আল্লাহ-সচেতনতা অর্জন হলো রোযার মূল শিক্ষা। এ শিক্ষা শুধু রমযান মাসের জন্য নয়। রমযানের একমাস কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার মাধ্যমে মু’মিন ব্যক্তি যে তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করে, সে অনুযায়ী সে জীবন যাপন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। তাই তাকওয়া অর্জন শুধু রমযানের একমাসের জন্য নয়, বছরের বাকি এগারটি মাস তথা সমগ্র জীবনই এ শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা বাঞ্ছনীয়। কোন মু’মিন কঠোর ত্যাগ ও কৃচ্ছ্র সাধনার মাধ্যমে রমযানে বিশেষ কতগুলো গুণ অর্জন করে, রমযান মাস শেষ হলেই সেসব গুণাবলী সে পরিত্যাগ করতে পারে না। কোন মু’মিনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। যদি কেউ তা করে তাহলে সে প্রকৃত মু’মিন নয় অথবা রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সে মোটেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, রমযানে মানবীয় গুণাবলী অর্জনের যে ট্রেনিং হয়, রোযাদার সারা বছর বা সারাজীবন তা অনুসরণ করে কল্যাণময় সুন্দর জীবনের অধিকারী হবে এটাই প্রত্যাশিত।
রোযার উদ্দেশ্য হলো সব মিথ্যা-অসত্য, অন্যায়-অবিচার-অনাচার, লোভ-লালসা, পাপ ও গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে শুধুমাত্র আল্লাহ্র হুকুম পালনার্থে ত্যাগ, সংযম, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে উন্নত মানবীয় গুণাবলী অর্জন। এরদ্বারা রোযাদার প্রকৃত ইনসানে কামিল বা উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজ ও পৃথিবীকেও সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণময় আদর্শ সমাজ রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এটাই। কারণ মানুষ নিয়েই সমাজ গঠিত। মানুষ চরিত্রবান ও উত্তম গুণাবলীর অধিকারী হলে সমাজ সুন্দর হয়, আর মানুষ চরিত্রহীন ও মানবীয় গুণাবলী বিবর্জিত হলে সমাজ বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
মহান স্রষ্টা পবিত্র রমাযান মাসেই মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাযিল করেন। আল-কোরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য এক মহা নিয়ামত। স্রষ্টা-প্রদত্ত এ গ্রন্থ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির হিদায়েতের জন্য। যারা এ থেকে হিদায়েত লাভ করেছে, তাদের বলা হয় মুসলিম। হিদায়েত লাভের পর মুসলমানদের দায়িত্ব হলোÑ স্রষ্টা-প্রদত্ত এ গ্রন্থের নির্দেশানুযায়ী নিজের জীবন গঠন, সমাজ গঠন, রাষ্ট্র গঠন তথা দুনিয়ায় আল্লাহর বিধান পরিপূর্ণরূপে কায়েম করা। আল্লাহর বিধান অনুসরণ করলে যেমন দুনিয়ায় শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি লাভ সম্ভব, আখিরাতে নাযাত লাভ সম্ভব। তাই মুসলমানের উপর ওয়াজিব হলো এ কল্যাণের বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। মহান আল্লাহ্ বলেন : “রমযান মাসÑ এ মাসেই মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোযা রাখে।” (সূরা বাকারা, আয়াত- ১৮৫)।
উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, মানবজাতিকে সঠিক পথ নির্দেশনা দানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এ গ্রন্থ নাযিল করা হয়। শুধু আল-কোরআনই নয়; অন্যান্য আসমানী কিতাবও এ মাসেই নাযিল হয়। রাসূল (সা.)-এর একটি হাদীস : “ইব্রাহীম (আ.)-এর সহীফাসমূহ রমযান মাসের প্রথম রাত্রিতে নাযিল হয়। তাওরাত কিতাব রমযানের ছয় তারিখ দিবাগত রাতে, ইঞ্জীল রমযানের তের তারিখে এবং কোরআন শরীফ রমযানের চব্বিশ তারিখে নাযিল হয়েছে।”
এ মাসে একটি মহিমান্বিত রজনী রয়েছে, যার নাম ‘লাইলাতুল কদর’। এ কদরের রাত্রিতেই আল-কোরআন নাযিল হয় এবং এ রাত্রির মর্যাদাকে হাজার মাসের অধিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন : “কদর (মহিমান্বিত) রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম।” (সূরা কদর, আয়াত : ৩)।
কদরের রাত্রিতে নাযিলকৃত কোরআন মজীদ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন : “এ কিতাবে (কোরআনে) কোনই সন্দেহ নেই, এটা মুত্তাক্বীদের (পরহেজগার) জন্য সুস্পষ্ট হিদায়াত (সঠিক পথ-নির্দেশনা)।”
আল কোরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য এক পরিপূর্ণ হিদায়াত গ্রন্থ (গাইড বুক)। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা বৈশ্বিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগের এক পরিপূর্ণ, নির্ভুল ও সর্বোত্তম দিক-নিদের্শনা হলো আল-কোরআন। একমাত্র এ নির্দেশনা অনুসরণ করেই জীবনে শান্তি, কল্যাণ ও সাফল্য অর্জিত হতে পারে। মানব-রচিত কোন দর্শন, জ্ঞান ও প্রযুক্তিই পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয়। তাই এ আসমানী কিতাবকে ধারণ, উপলব্ধি ও সঠিকরূপে অনুসরণের জন্য এ রমযান মাসকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কেননা এ মাসে কঠোর সিয়াম-সাধনার দ্বারা মানুষ যে মানবীয় গুণাবলী (তাকওয়া) অর্জন করে, সে গুণাবলী ব্যতীত আল-কোরআন সম্যক উপলদ্ধি ও অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আল-কোরআন ব্যতীত আমরা দুনিয়ায় সঠিক পথের সন্ধান পেতাম না। তাই এ মহাগ্রন্থ মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সেজন্য যে রাত্রিতে আল-কোরআন নাযিল হয়েছে সে রাত্রির মর্যাদা এত বেশি এবং যে মাসে এ বরকতপূর্ণ রজনী ও মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাযিল হয়েছে, সে মাসও অন্য সকল মাসের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান।
রমযান মাস অতি গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ্র অপরিসীম নিয়ামতে পূর্ণ এ মাস। এ মাসে রোযা রেখে রোযাদারগণ মানবীয় সর্বোত্তম গুণাবলী (তাক্ওয়া) অর্জন করে। এ মাসে মানবজাতির পথ-নির্দেশনার জন্য মহান স্রষ্টা মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাযিল করেছেন। রমযান মাসের এ প্রাপ্তিকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলা যায়। কারণ মানবীয় সর্বোচ্চ গুণাবলী অর্জনের চেয়ে জীবনে বড় কোন প্রাপ্তি নেই এবং মানবজাতির পথ-প্রদর্শনের জন্য মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের চেয়ে বড় কোন নিয়ামত নেই। মানবীয় গুণাবলী অর্জন ও আল-কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপন করে মানুষ ‘আশরাফুল মখলুকাত’ বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ রূপে গণ্য হতে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তি ও কল্যাণ লাভে সক্ষম হয়।
সকল প্রাপ্তির মধ্যেই আনন্দ রয়েছে। রমযানের অফুরন্ত নিয়ামত প্রাপ্তির পর রোযাদারের মন স্বভাবতই অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়। রমযানের শেষে তাই শাওয়ালের প্রথম দিনে রোযাদারগণ ঈদ উৎসব পালন করে। ‘ঈদ’ মানে আনন্দ। রমযানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সর্বোচ্চ মানবীয় গুণাবলী অর্জন করে। এ মাসে নাযিলকৃত আল-কোরআনের আলোকে মানবজাতি পৃথিবীতে চলার সঠিক দিক-নির্দেশনা পেয়েছে। এ মাসে যাকাত, ফিত্রা ও সদ্কা বিতরণের মাধ্যমে গরীব-দুঃখী বা সমাজের ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়। সকলে একসাথে মিলে ঈদ উৎসব পালন করে। তাই ঈদের আনন্দ সর্বজনীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ।
ঈদের আনন্দ অন্যসব আনন্দের মতো নয়। এটা মহাপ্রাপ্তির আনন্দ। এ মাসে স্রষ্টার নির্দেশ পালনার্থে মানুষ রোযা রাখে। আল্লাহর নির্দেশ পালনের ফলে আল্লাহ্ খুশী হন, বান্দার প্রতি তিনি অপরিসীম রহমত, দয়া ও প্রশান্তি নাযিল করেন। আখিরাতে জান্নাত লাভের নিশ্চয়তা প্রদান করে। রোযা রেখে বান্দা দেহ-মনের পবিত্রতা অর্জন করে, কঠোর কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন, ত্যাগ ও সংযম সাধনার মাধ্যমে মানবীয় মহত্তম গুণাবলী অর্জন করে। মানবীয় মহত্তম গুণাবলী অর্জনের চেয়ে জীবনে বড় কোন সাফল্যের কথা চিন্তা করা যায় না। রমযান মাসে দান-খয়রাত-সদকা প্রদান, ইফতারি বিতরণ, রোযাদারদের আপ্যায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেকাংশে মোচন হয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব-মমত্ব, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। সমাজে ধনী-গরীবের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয় এবং শান্তির অনাবিল আনন্দময় পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে ঈদের আনন্দ হয় প্রগাঢ়। এ আনন্দ ব্যক্তি থেকে সমষ্টি তথা সমগ্র চরাচরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই ঈদের আনন্দ সর্বব্যাপী ও সর্বজনীন। এ আনন্দ মুসলিম বিশ্বে তথা সমগ্র মানবসমাজে অপার শান্তি, স্বস্তি ও কল্যাণ নিয়ে আসুক। এবারের ঈদে এই হোক সকলের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন