এক বিশিষ্ট কাশ্মীরি ও আমেরিকান ফার্নিচার চেইন এথান অ্যালেন-এর প্রধান নির্বাহী ফারুক কাথওয়ারি প্রশ্ন করেন, সেখানে বিনিয়োগ করবে কে? তিনি বলেন, ভারতের নিরাপত্তা কর্মীরা যে ভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন তা মানুষের সম্মানকে ভুলুন্ঠিত করেছে। তারা কাশ্মীরিদের মনে ক্রোধের আগুন জে¦লেছে এবং এই ক্রোধ তাদের দিয়ে সব কিছু করাবে।
গত ৫ আগস্ট থেকে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীর হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি মিয়া কাইয়ুম, কাশ্মীর অর্থনৈতিক জোটের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইয়াসিন খান, দুর্নীতি বিরোধী যোদ্ধা রাজা মুজাফ্ফর ভাট, ট্রাক্টর চালক ফায়েজ আহমদ মীর এবং কাশ্মীরের প্রথম নির্বাচিত মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। শাহ ফয়সাল নামে একজন রাজনীতিককে নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার ব্যাগগুলো পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল। হাতে ছিল বোর্ডিং পাস। তিনি হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে ফেলোশিপ করতে যাচ্ছিলেন। আরো কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনীতিককে গৃহবন্দি করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন পত্রিকাকে জানান যে তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কাশ্মীরি আইনজীবী জাফর শাহ বলেন, এসব গ্রেফতার ও আটকাদেশ সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক। ধনাঢ্য ববসায়ী ৬৩ বছর বয়স্ক মুবিন শাহর গ্রেফতারের ঘটনায় তার স্ত্রী এখন পর্যন্ত হতবুদ্ধি হয়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, মুবিন শাহ ছিলেন নিছকই ব্যবসায়ী। তিনি কাশ্মীরি দুর্লভ শিল্পসামগ্রী ও কার্পেটের ব্যবসা করতেন। তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাশ্মীরে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে উৎসাহিত করতেন যা মোদি সরকারও চায়। তার স্ত্রী বলেন, কিছু কাশ্মীরি পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেফতার করতে অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু তাদের পিছনে ছিলেন কয়েক ডজন ভারি অস্ত্রসজ্জিত কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা।
বিশ্লেষকরা বলেন, কাশ্মীরে মোদি সরকার সবই করেছে সতর্ক পরিকল্পনায় ও তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপ বাস্তবায়ন করা হয় ২০১৮ সালে। বিজেপির কাশ্মীর শাখা একতরফা ভাবে কাশ্মীরের জোট সরকার থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে কাশ্মীরের শীর্ষ দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তার অর্থ এই যে কেন্দ্র সরকারের লোক রাজ্যের গভর্নর রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। কাশ্মীরের রাজনীতিকরা নার্ভাস হয়ে পড়তে শুরু করলেন। তাদের মনে আশঙ্কা দেখা দেয় যে মোদি সংবিধানের ৩৭০ ধারা পরিবর্তনের চক্রান্ত করছেন। যাতে কাশ্মীরকে বিশেষ ভূমি অধিকার এবং নিজস্ব আইন প্রণয়নের জন্য সুষ্ঠু স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই ধারা বাতিল করা ছিল মোদির নির্বাচনী অঙ্গীকার।
৩৭০ ধারায় বলা হয়েছে যে কাশ্মীরের মর্যাদার কোনো পরিবর্তন করতে হলে কাশ্মীরের জন প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে তা করতে হবে। কিন্তু কাশ্মীরের রাজনীতিকরা জানতেন যে একজন গভর্নর কর্তৃক যদি অব্যাহত ভাবে রাজ্য শাসিত হয়। রাজ্য বিধান সভা না থাকে। তাহলে জনপ্রতিনিধিদের ছাড়াই মোদির পরিবর্তনের কাজটি করে ফেলার ঝুঁঁকি রয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি গভর্নরের কাছে একটি ফ্যাক্স পাঠান। এতে তিনি বলেন যে তার পর্যাপ্ত মিত্র আছে এবং তিনি নয়া সরকার গঠনে প্রস্তুত। এটা তিনি সামাজিক মাধ্যমেও পোস্ট করেন। কিন্তু গভর্নর অকস্মাৎ রাজ্য বিধান সভা ভেঙে দেন। এটা ছিল দ্বিতীয় পদক্ষেপ। গভর্নর বলেন যে তিনি মেহবুবার ফ্যাক্স পাননি। তিনি নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানান। এটা তৃতীয় পদক্ষেপের সূচনা করে নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
একজন ভারতীয় কর্মকর্তা হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাতীয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত অভিজ্ঞ আমলাদের একটি টিম জুন মাসের দিকে কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কিন্তু বিজেপি বিধায়করা মনে হয় নির্বাচন বন্ধ করতে চাইছিলেন। তারা কিছু অদ্ভুত যুক্তি হাজির করলেন। তারা বললেন যে জুনে নির্বাচন হলে জঙ্গিরা গ্রীষ্মকালের লম্বা ঘাসের মধ্যে আশ্রয় নিতে পারে। তাই নির্বাচন নভেম্বরে হলে ভালো হবে। তখন নির্বাচন কমিশন বছরের শেষ পর্যন্ত কোনো তারিখ নির্ধারণ না করে নির্বাচন স্থগিত করে।
ফলে গত ৫ আগস্ট মোদি যখন কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেন তখন বিধান সভা কার্যকর ছিল না। তার সরকার দাবি করে যে বিধান সভার অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য শাসনের ক্ষমতা রাখে। নয়াদিল্লীর এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যাপিমন জ্যাকব বলেন, ক্ষমতার সুবিধা পাওয়ার জন্য সরকার আরো কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করে। এটা ঠিক যে নির্বাচনের মাধ্যমে যা করা যায় সাধারণ ভাবে তা করা সম্ভব নয়।
সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিল সব বন্ধ করে দেয়া। গত ৫ আগস্ট মধ্যরাতের সামান্য আগে কশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট ও ফোন সার্ভিস বিচ্ছিন্ন করে দেয়। হাজার হাজার কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা অফিসারকে সক্রিয় করে।
তাদের কয়েক ডজন মুবিন শাহকে আটক করে অন্যরা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের আটক করতে উপত্যকার ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দেয়। কমপক্ষে ২০ জন ভাটের বাড়িতে হাজির হয় বলে তার পরিবার জানায়। তারা আরো জানান যে এর আগে কখনো তিনি গ্রেফতার হননি, এমনকি এক ঘণ্টার জন্যও নয়।
ভাটের স্ত্রী ফিরোজা কায়সারকে তার গ্রেফতারের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, কোনো কারণ তাদের জানানো হয়নি। কাশ্মীরী পুলিশ বলেছে, তারা গ্রেফতারের কারণ জানে না। আদেশের প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সরকার হয়ত জন সুরক্ষা আইন ব্যবহার করতে পারে। এ আইনে কাউকে রাষ্ট্রের প্রতি হুমকি মনে করলে সরকার কোনো অভিযোগ না এনেই যে কাউকে দুই বছর পর্যন্ত আটক রাখতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আইন আছে। একটি উপদেষ্টা বোর্ড বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।
মুবিন শাহকে আটক করার কয়েকদিন পর তার বড় ভাই শ্রীনগরের একটি জেলে তার সন্ধান পান। তিনি তার সাথে দেখা করেন। পরদিন সকালে তিনি কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে যান তাকে দেয়ার জন্য। কিন্তু জেলখানার রক্ষীরা জানায় যে একটি সামরিক বিমানে করে মুবিন শাহকে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। (শেষ)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন