রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

বিশ্ব উপেক্ষা করতে পারে না কাশ্মীরকে

নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিবন্ধ

ইমরান খান | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

গত বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা বিষয়গুলোর একটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী ও ন্যায্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় জন্য কাজ করা। জটিল ইতিহাস সত্তে¡ও ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে হিমবাহ গলে যাওয়ার হুমকি ও পানির অভাবের মত একই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

বাণিজ্য ও আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা কাশ্মীর বিরোধ সমাধানের মাধ্যমে আমি ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলাম।
নির্বাচনে জয়লাভের পর ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই পাকিস্তানিদের প্রতি আমার প্রথম টেলিভিশন ভাষণে আমি বলেছিলাম যে আমরা ভারতের সাথে শান্তি চাই। ভারত যদি এক্ষেত্রে এক পা এগোয়, আমরা দুই পা এগোব।
এর পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আমাদের দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের মধ্যে এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। কিন্তু ভারত সে বৈঠক বাতিল করে। সেই সেপ্টেম্বরেই আমি সংলাপ ও শান্তির আহ্বান জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে লেখা আমার তিনটি পত্রের প্রথম পত্রটি লিখি।

দুর্ভাগ্যক্রমে শান্তির জন্য একটি সংলাপ শুরুর আমার সকল প্রচেষ্টা ভারত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রাথমিক ভাবে আমরা মনে করেছিলাম যে মোদির ক্রমবর্ধমান ভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ ও বাগাড়ম্বরের উদ্দেশ্য বোধ হয় মে মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন উপলক্ষে ভারতীয় ভোটারদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জোশ জাগিয়ে তোলা।

এ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এক কাশ্মীরি তরুণ ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে এক আত্মঘাতী হামলা চালায়। ভারত সরকার এ জন্য তড়িঘড়ি করে পাকিস্তানকে দায়ী করে।
আমরা ভারতের কাছে প্রমাণ চাই। কিন্তু মোদি ভারতীয় বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলোকে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালাতে পাঠান। আমাদের বিমান বাহিনী একটি ভারতীয় জঙ্গি বিমান ভ‚পাতিত ও পাইলটকে আটক করে। আমরা আমাদের রক্ষা করতে পারি তা জানাতে পাল্টা হামলা চালাই। কিন্তু এমন কোনো স্থানে আঘাত করিনি যাতে জীবনহানি ঘটতে পারে। আমি অত্যন্ত সচেতন ভাবে এটা দেখানোর সিদ্ধান্ত নেই যে দুটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত দেশের মধ্যে যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমরা কোনো পূর্ব শর্ত ছাড়াই আটক ভারতীয় পাইলটকে ফেরত দিই।

চলতি বছরের ২৩ মে মোদি পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করতে পারব বলে আশা প্রকাশ করি। শান্তির লক্ষ্যে কাজ করতে সংলাপ শুরুর প্রস্তাব দিয়ে জুন মাসে আমি মোদির কাছে আরেকটি চিঠি পাঠাই। কিন্তু ভারত আবারও তার উত্তর না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

আমরা দেখতে পাই যে আমরা যখন শান্তি প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা প্রদর্শন করছি ভারত তখন আন্তঃসরকারী আর্থিক অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সে (আইএফএটিএফ) পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে লবিং করছে। যা আমাদের গুরুতর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংক দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারত।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মোদি পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে শান্তির জন্য আমাদের ইচ্ছাকে তোষণ হিসেবে ভুল করেছেন। আমরা শুধু এক বৈরী সরকারের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান নই। আমরা একটি নতুন ভারতেরও বিরুদ্ধে দন্ডায়মান যা এমন নেতৃবৃন্দ ও দলের দ্বারা শাসিত। যারা হিন্দু আধিপত্যবাদী মাতৃদল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস থেকে উদ্ভ‚ত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও কয়েকজন মন্ত্রী আরএসএসের সদস্য। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা বেনিতো মুসোলিনি ও এডলফ হিটলারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি আরএসএসের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা এমএস গোলওয়ালকরের প্রতি বিপুল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে লিখেছিলেন এবং তাকে ‘পূজনীয় শ্রী গুরুজী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

মোদির গুরু ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত তার ‘উই, আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ নামক বইতে চ‚ড়ান্ত সমাধানের ব্যাপারে লিখেছেন : ‘জাতি ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য জার্মানি ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান চালিয়ে বিশ^কে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় গৌরবকে এখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রদর্শন করা হয়েছে। জার্মানি আরো দেখিয়েছে যে শিকড়ের গভীরে বিরাজ করা পার্থক্য নিয়ে জাতি ও সংস্কৃতির পক্ষে কিভাবে কাছাকাছি হওয়া ও এক জাতি হিসেবে সমন্বিত হওয়া অসম্ভব। এটা হিন্দুস্তানে আমাদের জন্য ভালো শিক্ষা।’

আমি আশা করেছিলাম যে একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়াটা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকলে তিনি যা করেছিলেন সেই পুরনো পথ থেকে মোদিকে সরিয়ে আনবে। ২০০২ সালে সেখানকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার নজরদারিতে পরিচালিত কর্মসূচি তাকে বিশ্বব্যাপী কুখ্যাতি এনে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সেদেশে ভ্রমণ ভিসা দিতে অস্বীকার করে। আরো কিছু দেশ তাকে ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় যা তাকে সার্বিয়ার মুসলিম হত্যার কসাই বলে কুখ্যাত সেøাবোদান মিলোসেভিচের সহযোগীদের পর্যায়ে নিয়ে যায়।

মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদে উগ্রপন্থী হিন্দু জনতা কর্তৃক মুসলিম, খ্রিস্টান ও দলিতদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে আমরা কাশ্মীরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় সহিংসতা দেখেছি। সেখানে শটগান ব্যবহার করা হচ্ছে এবং কিশোর- তরুণ কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের চোখ লক্ষ্য করে ছররা গুলি চালানোর ফলে শত শত ছেলে অন্ধ হয়ে গেছে।

গত ৫ আগস্ট এক বেপরোয়া ও মারাত্মক পদক্ষেপে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ অনুচ্ছেদ বাতিলের পদক্ষেপ গ্রহণ করে মোদি সরকার ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের মর্যাদা পরিবর্তন করেছে। ভারতের সংবিধানের আওতায় এ পদক্ষেপ বেআইনি। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এটা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাশ্মীর বিষয়ক প্রস্তাব এবং ভারত-পাকিস্তান সিমলা চুক্তির লংঘন।
মোদির নতুন ভারত কাশ্মীরে সামরিক কারফিউ আরোপ করে। কাশ্মীরের জনগণকে বাড়িতে বন্দি রাখে। তাদের ফোন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। বিশ্ব সংবাদ বা তাদের নিকট জনের খবর পাওয়ার উপায় রাখেনি।

হাজার হাজার কাশ্মীরিকে গ্রেফতার ও তাদেরকে ভারতজুড়ে বিভিন্ন কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে কাশ্মীর অবরোধ করা হয়েছে। কারফিউ প্রত্যাহারের সাথে সাথে সেখানে রক্তনদী বয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কাশ্মীরিরা ইতোমধ্যেই যারা কারফিউ অমান্য করে বাইরে বের হচ্ছেন তাদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।
বিশ্ব যদি কাশ্মীর ও কাশ্মীরিদের উপর ভারতের হামলা বন্ধে কিছু না করে তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দুটি দেশ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সরাসরি সামরিক যুদ্ধের নিকটবর্তী হবে। যার পরিণতির শিকার হবে গোটা বিশ্ব।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কোনো রাখঢাক না করেই পাকিস্তানের প্রতি হুমকি দিয়ে বলেছেন, ভারত প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। এ নীতির ভবিষ্যত নির্ভর করবে পরিস্থিতির উপর। ভারতের নেতারাও এ ধরনের কথা মাঝেমধ্যে বলে থাকেন। পাকিস্তান ভারতের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নয়, নীতি বিষয়ে দীর্ঘদিন থেকেই সন্দেহ পোষণ করে আসছে।

দক্ষিণ এশিয়ার উপর যখন পারমাণবিক যুদ্ধের ছায়া ঘনাচ্ছে তখন আমরা উপলব্ধি করছি যে পাকিস্তান ও ভারতকে নেতিবাচক মনোভাব পরিত্যাগ করে কাশ্মীর, বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় ও বাণিজ্য নিয়ে সংলাপ শুরু করা উচিত। কাশ্মীর বিষয়ে সংলাপে সকল পক্ষই বিশেষ করে কাশ্মীরিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই বহুমুখী বিষয় প্রণয়ন করেছি যা কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে যা নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে রয়েছে এবং ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহর লাল নেহরু যার অঙ্গীকার করেছিলেন।
সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ কাশ্মীরি জনগণের কয়েক দশকের দুর্ভোগের একটি টেকসই সমাধানে পৌঁছতে এবং এ অঞ্চলে স্থিতিশীল ও ন্যায্য শান্তির দিকে অগ্রসর হতে পারেন। কিন্তু সংলাপ শুধু তখনি শুরু হতে পারে যদি ভারত কাশ্মীরের অবৈধ অন্তর্ভুক্তি বাতিল, কারফিউ ও অবরোধ প্রত্যাহার করে এবং সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই কাশ্মীর বিষয়টি বাণিজ্য ও ব্যবসা সুবিধার বাইরে রেখে চিন্তা করতে হবে। বিশ্ব কাশ্মীরকে উপেক্ষা করতে পারে না। আমরা সকলেই বিপদে আছি। মিউনিখে তোষণের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। একই ধরনের হুমকি বিশে^র উপর ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু এবার তা আসছে পারমাণবিক ছায়ার নীচে।
(পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এ নিবন্ধটি গত ৩০ আগস্ট দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়।)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Razib Shaha ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:১৯ এএম says : 0
ঠিক কথাই বলেছেন
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন