বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

নজরুলের সাহিত্য ও ইসলাম

শাহরিয়ার সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯খৃ.- ১৯৭৬খৃ.) এক বিস্ময়কর প্রতিভা। যার অসংখ্য গান ও কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে। তার সৃষ্টির মূল বক্তব্য চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র শৈল্পীক প্রতিবাদ তাকে কালজয়ী করেছে, অমর করেছে। সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় পেয়েছেন শ্রদ্ধার আসন। তিনি ধর্মের চেয়ে মানবতাকে বড় করে দেখলেও, ধর্মকে ছোট করে দেখেননি। বিশ্বের কোন ধর্মই মানবতাহীন নয়। ইসলাম ধর্মকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। মুসলমানদের নিয়ে তিনি বহু গান ও কবিতা লিখেছেন, যা আজও ভক্ত মুসলমানদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। ইসলামের সত্যকে তিনি প্রাণে ধারণ করে তার সাহিত্য কর্মের বহুলাংশ সম্পাদন করেছেন।

মূলত কাজী নজরুল ইসলাম এক তুখোড় আততি আর নিনাদ বিষাদময় কবি। ক্ষুধা-নিপীড়ন-অত্যাচার-না পাওয়ার বেদনার বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ উচ্চকিত। আতীব্র জীবনাসক্তি, নিজস্ব চৈতন্য-পৃথিবী উন্মোচনের তীব্র তাড়না, সৌন্দর্য্য ও শিল্প উত্তীর্ণতার আকর্ষতা এবং সময়ের হররা ও বিদীর্ণতা পর্যালোচনায় তার কবিতা উজ্জ্বল ও দীপ্রতর। ঐতিহ্য-লালসা, প্রেম লিপ্সা, রোমান্টিক পরিব্রাজকতা, কৃষকতা এবং সভ্যতার কুহকবৃত্ত তার কবিতার শরীরী সংগুপ্ততায় লীন হয়ে আছে। আত্মক্লেদ-গ্লানি, বিমর্ষতা ও যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও বিপন্নতা বোধের শিখরকে অতিক্রম করে সময়ের উপদংশে কাতর হয়েও তিনি তার কলম চালিয়েছেন নতুন উৎসার ও দেদীপ্যমানতায়। কাজী নজরুল ইসলাম আজও ভাস্বর আমাদের চেতনার চৌকাঠে।
কাজী নজরুল ইসলাম জিহাদ করেছেন। জিহাদ করতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। জিহাদ করতে হবে সশরীরে, পরিস্থিতি অনুকূল না হলে মুখে প্রতিবাদ করতে হবে, পরিস্থিতি যদি ততটুকুও অনুকূল না হয়, তবে মনে মনে ঘৃণা করতে হবে। সূরা বাকারার ১৯৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তাদের সাথে সংগ্রাম করতে থাকো যতক্ষণ না ধর্ম দ্রোহিতা চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যায় ও দীন কেবল আল­াহর জন্যই নির্দিষ্ট হয়।’ সূরা নিসার ৭৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে আল­াহর পথে, আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। অতএব, তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। আর শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল।’ সূরা আনফালের ৬৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী! ঈমানদারকে লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন।’ বুখারী ও মুসলিম শরীফে উলে­খ আছে, ‘হযরত আবু যার গিফারী (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল­াহর রাসূল! কোন আমলটি (আল­াহর নিকট) সবচেয়ে উত্তম? তিনি উত্তরে বললেন ঃ আল­াহর ওপর ঈমান আনা এবং তার পথে জিহাদ করা।’ আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ থেকে জানা যায়, ‘হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন ঃ আমি কি তোমাদের প্রকৃত দীন, তার স্তম্ভ ও তার চূড়া সম্পর্কে অবহিত করব? আমি বললাম, হ্যাঁ, আল­াহর রাসূল। তিনি বললেন, দীনের মূল স্তম্ভ হলো ইসলাম, তার স্তম্ভ হলো নামায এবং তার সর্বোচ্চ চূড়া হল জিহাদ।’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বলেছেন,
পৃথিবীতে যুগে যুগে কালে কালে নারীর ওপর বহু অত্যাচার হয়েছে। ইসলাম সর্বপ্রথম নারীকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। মা হিসাবে, বোন হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে, কন্যা হিসাবে সর্বত্র নারীকে মর্যাদাবান করেছে। সূরা নিসার ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সন্তুষ্ট চিত্তে স্ত্রীগণকে তাদের প্রাপ্য মহর দিয়ে দাও।’ সূরা নিসার ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নারীদের রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্ধারিত অংশ।’ সূরা নিসার ১২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর পুরুষ বা স্ত্রী যারাই ঈমানদার হয়ে নেক আমল করবে তারাই বেহেশতে দাখিল হতে পারবে। এ ব্যাপারে কারো প্রতি এক বিন্দু জুলুম করা হবে না।’ একটি সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, ‘নবীজিকে যখন তার এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন; বাবা ও মা এর ভেতর কার গুরুত্ব অধিক? তিনি বললেন, মা। প্রশ্ন করা হলো, এরপর? মা। আবারও প্রশ্ন করা হলো, এরপর? উত্তর এলো-মা; এবং চতুর্থবারে উত্তর এলো-বাবা।’ এক্ষেত্রে নারীকে মহীয়ান করা হয়েছে। আবু দাউদ থেকে জানা যায়, ‘হযরত হাকিম ইবন মুআবিয়া (রা.) তার পিতা মুআবিয় (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, আমি রাসূলুল­াহ (সা.) জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল­াহর রাসূল! স্বামীর ওপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে? তিনি বললেন ঃ তার অধিকার হলো যখন তুমি খাবে তখন তাকে খাওয়াবে, তুমি যখন যে মানের কাপড় পরবে তাকেও সে মানের কাপড় পরাবে। তার মুখে আঘাত করবে না। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করবে না। গৃহে ব্যতীত অন্য কোথাও তার সঙ্গ ত্যাগ করবে না।’ আবু দাউদ থেকে আরও জানা যায়, ‘হযরত ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন, যার কন্যা সন্তান আছে সে যদি তাকে (জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায়) জীবিত কবর না দেয় এবং তাকে তুচ্ছ মনে না করে, আর পুত্র সন্তানকে উক্ত কন্যা সন্তানের ওপর প্রাধান্য না দেয় তাহলে আল­াহ তাকে বেহেশত দান করবেন।’ কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন,
‘আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্র“ বারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।’
একই কবিতায় তিনি আরও বলেছেন,
‘কোনো কালে একা হয়নি’ক জয়ী পুরুষের তরবারী;
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়ী লক্ষী রাণী।’
এছাড়াও তিনি একই কবিতায় আরও বলেছেন,
‘সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’
শিশু ও এতিমদের নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বহু ছড়া ও গান রচনা করেছেন। ইসলামে শিশু ও এতিমদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের øেহ করতে বলা হয়েছে। শিশুরা নিষ্পাপ, ফুলের মতোই পবিত্র। সূরা নিসার ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা ইয়াতীমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে , তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করে এবং সত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ সূরা নিসার ১২৭ নং আয়াতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইয়াতীমদের প্রতি ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার কর। তোমরা যা ভাল কজে কর, আল­াহ্ তা সবিশেষ অবহিত।’ ইয়াতীম শিশুদের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম শিশুদের উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন, কারণ ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ শিশুরা দুর্বল নয়, অসহায় নয়। তারাই একদিন জাতির কর্ণধার হবে। তিনি বলেছেন,
‘তুমি নও শিশু দুর্বল
তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার বিপুল বিরাট
অমৃতের সন্তান।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্রষ্টাকে শিশুদের মতো পবিত্র, নির্মল, উজ্জ্বল মনে করেন। তাইতো তিনি লিখেছেন,
‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাটও শিশু আনমনে।’
‘হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।’
পরম করুণাময় আল­াহ, শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ব জগতের জন্য। পবিত্র কোরান শরীফ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমস্ত মানুষের জন্য। হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু মুলমানদের জন্য নয়, সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমত স্বরূপ এসেছেন। ইসলাম ধর্ম মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছে। সূরা কাফিরূন এর ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম।’ দ্বীনের ব্যাপারে কোন বাড়াবাড়ি নেই। আবু দাউদ থেকে আমরা জানতে পারি, ‘রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন ঃ মনে রেখ, যদি কোন মুসলমান কোন অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার শক্তির বাইরে কোন বিষয় তার ওপর চাপিয়ে দেয়, তার কোন বস্তু জোর পূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল­াহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব।’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখাগুলি মূলত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। কোন সা¤প্রদায়িকতা নয়, প্রত্যেক মানুষই ভাই-ভাই, এ সত্য তিনি প্রচার করেছেন। তিনি গেয়েছেন,
যে সব মানুষের ঘামের বিনিময়ে সভ্যতা নির্মিত হয়েছে, কবি তাদের জয়গান করেছেন। যদিও অনেক শ্রমিকই ন্যায্য মূল্য পায় না। তাদেরকে ফাঁকি দেয়া হয়। তাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন করা হয়। কবির বিদ্রোহ শ্রমিকদের পক্ষে আর শোষক ধনীদের বিরুদ্ধে উচ্চকিত। সূরা কাসাসের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তুমি যাকেই মজুর হিসাবে নিযুক্ত করবে, তন্মধ্যে শক্তিমান ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা উত্তম।’ ইবনে মাজাহ থেকে জানা যায়, ‘হযরত ইবন উমাহ (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন ঃ তোমরা মজুরের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও।’ বায়হাকী থেকে জানা যায়, ‘মজুরের মজুরী নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করতে রাসূলুল­াহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন।’ ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
‘দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
‘কুলি-মজুর’ কবিতায় তিনি আরও বলেছেন,
‘তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।
তুমি শুয়ে রবে তে’তলার পরে, আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!’
(অসমাপ্ত)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন