প্রবাদে রয়েছে ‘সরকারের হাত অনেক লম্বা’। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সরকারের চেয়েও হাত লম্বা ক্যাসিনো ডন সেলিম প্রধানের। স্থানীয় প্রশাসন যন্ত্র তাঁর কাছে কার্যত নতি শিকার করেছে। মহাসড়কের ওপর এই ক্যাসিনো ডনের ভবন ভাংতে পারছে না। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন ক্যাসিনো ডন সেলিম প্রধানের কাছে প্রশাসনযন্ত্রের এই অসহায়ত্বের নেপথ্যের রহস্য কি?
ঢাকা টু সিলেট মহাসড়কের গাউছিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের চার তলা বিশিষ্ট ফ্লাইওভারের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সড়ক ও জনপদ বিভাগের একোয়ারভুক্ত মাত্র ১৫ শতাংশ জমি ক্যাসিনো ডন সেলিম মিয়া ওরফে সেলিম প্রধানের জবরদখলে থাকায় কাজটি অসমাপ্তই রয়ে গেছে। সেলিম নিজের এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি দখলে থাকা সড়ক ও জনপদ বিভাগের জমি ছাড়ছেন না। ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন বার বার ওই জমিতে থাকা পাঁকা স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলেও বিশেষ ফোনের কারণে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। সেলিমের পিছনে কে এই ক্ষমতাধর ব্যাক্তি যার ফোনে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়? এলাকাবাসীর দাবি, সেলিম প্রধানের সঙ্গে জড়িত ওই প্রভাবশালী বিশেষ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
জানা গেছে, ভুলতা-গোলাকান্দাইল এলাকা ক্রস করেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান হাইয়ে বাইপাস সড়ক। এ এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাটবাজার ও ব্যস্ততম থাকায় প্রতিদিন শত শত যানবাহন এবং লাখ লাখ মানুষের চলাফেরা। প্রতিদিনই এ এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হতো। নিত্যদিনের যানজটের কারণে ভোগান্তির অন্ত ছিল না। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনা হয়। পরে তিনি ভুলতা-গোলাকান্দাইল এলাকায় একটি ফ্লাওভার নির্মাণের উদ্যেগ নেন এবং দ্রুত এর নির্মাণ কাজে হাতে নেন। জনগণের ভোগান্তি কমাতে ফ্লাইভারটি দ্রুত কাজ শুরু করে সমাপ্তও করা হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ফ্লাইভারের গোলাকান্দাইল সাওঘাট এলাকার অংশে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ের মালিক সেলিম প্রধানের দখলে রয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অংশের সাওঘাট এলাকায় সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি। ওই জমিতে পাঁকা স্থাপনা রয়েছে। জমি দখলে থাকায় সড়কের ওই অংশে মাত্র ১০ থেকে ১২ ফুট প্রশস্থ্য। সড়কের ওই অংশ দিয়ে বড় ধরনের যানবাহন চলাফেলা করতে পারছে না। রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল করতে পারছে। এতে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ফ্লাইভারটি সুবিধা ভোগ থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে মানুষ। এতে করে যেমন সরকারের ভাবমুর্তী নষ্ট হচ্ছে, তেমনি স্থানীয়দের মাঝেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ওই জমি দখলমুক্ত হলে সড়ক ৫০ থেকে ৬০ ফুট প্রশস্থ্য হবে। যানবাহন চলাচলে আর সমস্যা হবে না।
কে এই সেলিম প্রধান ঃ
রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই মর্তুজাবাদ গ্রাম। প্রায় ৩০ বছর আগে এ এলাকার জরাজীর্ণ ‘চাঁন মিয়া ও স্ত্রী সফুরা খাতুন মঞ্জিল’। চাঁন মিয়ার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়া। আর নান্নু মিয়ার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। এর মধ্যে সেলিম মিয়া মেঝো। বড় ছেলের নাম আলম মিয়া ও ছোট ছেলের নাম নাদিম মিয়া। এখনো ‘চাঁন মিয়া ও স্ত্রী সফুরা খাতুন মঞ্জিল’ দেখে বোঝার উপায় নেই বাড়ির মালিক চাঁন মিয়ার নাতিনের মাসিক আয় ৯ কোটি টাকা। বর্তমানে সেলিম মিয়ার ক্যাসিনোর মধ্যমে উপরে উঠেছেন, নাম পরিবর্তে নাম হয়েছেন সেলিম প্রধান ওরফে ‘থাই ডন’। গ্রেফতারের পর টিভি পর্দায় সেলিম মিয়া এবং তার বাসা থেকে উদ্ধার করা টাকা-ডলার ইত্যাদি দেখে স্থানীয়দের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।
এলাকাবাসীর কাছে অবশ্য দুই যুগ আগেও সেলিম প্রধানের পরিচিতি ছিল আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া। ক্যাসিনোর মাধ্যমে কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক হওয়ার উঠে যান হাই সোসাইটিতে। বিলাসী জীবন যাপনের সেলিম মিয়া হয়ে যান সেলিম প্রধান। তবে বিশাল বিত্তবৈভব আর রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবে সেলিম প্রধান ও তার পরিবারের ব্যাপারে এলাকার মানুষ কথা বলতে এখনও সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে পৈতৃক বাড়ি এমন জরাজীর্ণ থাকলেও গাউছিয়া থেকে অল্প দূরেই ভুলতা ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের সেই আলোচিত ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস’ নামের বহুতল ভবন ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান। যেখানে ছাপানো হয় বাংলাদেশের সব ব্যাংকের চেক বই, এফডিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি।
যেভাবে সেলিম প্রধানের উত্থান ঃ
সরেজমিন রূপগঞ্জের মর্তুজাবাদ এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়া পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতেন। সংসারে ছিল অনটন নুন আনতে পাস্তা ফুরোয় অবস্থা। ওই সময় সেলিম প্রধান স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন। ওই সমিতির বেশ কিছু টাকা মেরে সবার অজান্তে চলে যান জাপানে। জাপান থাকা অবস্থায় তার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু জাপানের টোকিওতেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হন তিনি। জাপান থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি সেখান থেকে আমেরিকায় চলে যান। সেখানে এক আমেরিকানকে বিয়েও করেন। আমেরিকান স্ত্রীকে কাজে লাগিয়ে ফের জাপানে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে বাংলাদেশে ফিরে সেলিম প্রধান ওরফে সেলিম মিয়া আলোচিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক করে হয়ে যান তার ব্যবসায়িক পার্টনার।
এলাকাবাসী জানান, তারা সেলিম প্রধানকে বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হিসেবে জানলেও তিনি কোনো পদে ছিলেন না। সেলিম প্রধানের আপন চাচাতো ভাই আনোয়ার সাদাত সায়েম নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন সেলিম প্রধানের বদান্যতায়। সায়েম নিজেও জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ের পরিচালক ছিলেন। ক্যাসিনো স¤্রাট সেলিম প্রধানের বিভিন্ন অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সায়েম কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলেন। ১৫ বছর আগেও সায়েমের তেমন কোন সম্পদ ছিলো না।
এলাকাবাসী আরো জানান, হঠাৎ সেলিমের ‘পরিবর্তন’ ছিল চোখে পড়ার মতো। এলাকায় আসতেন বছরে ৩-৪ বার। সঙ্গে থাকত দামি গাড়িবহর, অস্ত্রধারী বডিগার্ড। বিশেষ নিরাপত্তায় চলাচল করেন তিনি। অপরদিকে সেলিমের সেই আলোচিত প্রিন্টিং প্রেসে গিয়ে প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। সেখানে কর্তব্যরত দুই ব্যক্তি নিজেদের পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, হেড অফিসের অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ করা যাবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিকদের কয়েকজন জানান গোপন তথ্য। মূলত বিদেশে ও দেশে ক্যাসিনোর পাশাপাশি স্পা ব্যবসা করা সেলিম নিয়মিত আসতেন এ প্রেসে। প্রেসের ভেতরে রয়েছে তার ‘বালাখানা’। প্রায় গভীর রাতে সেলিম এখানে আসতেন ঘনিষ্ঠদের নিয়ে। বিদেশি নাগরিকদেরও নিয়ে আসতেন। সঙ্গে থাকতেন সুন্দরী ললনা। টিভি-সিনেমার নায়িকাদের পদভারে মুখরিত ছিল রাতের জলসাঘর। ভোর পর্যন্ত চলত মদ্যপান, হৈহুল্লোড়।
জানা গেছে, র্যাবের হাতে গ্রেফতার সেলিম ‘প্রধান গ্রুপ’-এর কর্ণধার। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড, পি ২৪ ল ফার্ম, এইউ এন্টারটেইনমেন্ট, পি ২৪ গেমিং, প্রধান হাউস ও প্রধান ম্যাগাজিন। এর মধ্যে পি ২৪ গেমিংয়ের মাধ্যমে তিনি জুয়াড়িদের ক্যাসিনোয় যুক্ত করতেন। ব্যাংককের পাতায়ায় তার বিলাসবহুল হোটেল, ডিসকো বারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনাই নয়, সেলিম রাজশাহীসহ সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় গবাদিপশুর সব খাটাল ও মাদক সিন্ডিকেটের হোতা। এমনকি সীমান্তে জাল টাকার মূল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন