শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

শিক্ষাঙ্গন

গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ, তদন্ত না করে সমঝোতার চেষ্টা উপাচার্যের

জাবি সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৫ পিএম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চারজন শিক্ষক ও তাঁদের সহলেখকদের বিরুদ্ধে গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। উপাচার্য বরাবর পৃথকভাবে এসব লিখিত অভিযোগের ব্যাপারে তদন্তের উদ্যোগ না নিয়ে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী শিক্ষকদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক (গত ২২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে) মুহাম্মদ আশরাফুল হক একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান ও প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকের রূপালী আক্তারের বিরুদ্ধে একটি গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি জেবউননেছা ও সহযোগী অধ্যাপক হরে কৃষ্ণ কুন্ড এবং সহলেখকদের প্রকাশিত ৭ টি গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির পাল্টা অভিযোগ করেন অভিযুক্ত ছায়েদুর রহমান ও রূপালী আক্তার।

আশরাফুল হকের করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান ও রূপালী আক্তারের যৌথভাবে লেখা ‘এনভায়রনমেন্টাল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ: এ পলিসি রিভিউ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধটি ‘জাহাঙ্গীরনগর জার্নাল অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাডিজ’-এর ৩ নম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধটি টার্নিনিন সফওয়্যারের মাধ্যমে পরীক্ষা করে প্রবন্ধের ‘৫৭ শতাংশ’ লেখায় চৌর্যবৃত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব লেখায় ‘হুবহু কপি’, সাইটেশনের নিয়ম অমান্য করে কোটেশন ও প্যারাফ্রেস ব্যবহার না করার সন্ধান মিলেছে।

অন্যদিকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর লোক প্রশাসন বিভাগের সভাপতি জেবউননেছা, সহযোগী অধ্যাপক হরে কৃষ্ণ কুন্ড ও সহলেখকদের প্রকাশিত ৯ টি প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ করেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান। উপাচার্য বরাবর লিখিত এ অভিযোগে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘জাহাঙ্গীরনগর জার্নাল অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাডিজ’ ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে প্রকাশিত ‘দি জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ’ জার্নালের বিভিন্ন সংখ্যায় এই লেখকদের ৭ টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এসব প্রবন্ধের মধ্যে জেবউননেছা ও হরে কৃষ্ণ কুন্ডর লেখা ‘প্রবলেম অব গুড গভর্ন্যান্স ইন বাংলাদেশ: সাম রিমেডিস’ ও ‘হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ: ইস্যুজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’- এ টার্নিটিন সফটওয়্যার দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই দুটি লেখায় যথাক্রমে ৯৯ শতাংশ ও ৯৮ শতাংশ চৌর্যবৃত্তির সন্ধান মিলেছে।

অভিযোগে বলা হয়, হরে কৃষ্ণ কুন্ড ও জেবউননেছার লেখা ‘রিটেইনিং ট্যালেন্ট: এ স্ট্রাটেজিক টুল ফর সাসটেইনিং এন্টারপ্রাইজেস ইন বিজনেস ওয়ার্ল্ড’ এবং জেবউননেছা, মাহফুজা মুবারক ও হরে কৃষ্ণ কুন্ডর লেখা ‘পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ: প্রবলেমস অ্যান্ড সল্যুশন্স’ প্রবন্ধে যথাক্রমে ৫৯ শতাংশ ও ৫১ শতাংশ চৌর্যবৃত্তির সন্ধান দিয়েছে টার্নিনিন সফটওয়্যার।

এ ছাড়া মো. মনজুর মোর্শেদ, জেবউননেছা ও মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন লিখিত ‘গভর্নমেন্ট ল্যান্ড সাপ্লাই অ্যান্ড প্রাইভেট রেসপন্স: এ হেডনিক অ্যাপ্রোচ টু ইলিগাল সাবডিভিশন প্রাইস অ্যানালাইসিস’, মো. মোখলেছুর রহমান, মো. মনজুর মোরশেদ ও জেবউননেছা ‍লিখিত ‘ইভ্যালুয়েশন অব ইন্সটিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্ক, পলিসিজ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস ফর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ মিটিগেশন ইন বাংলাদেশ’, মো. মনজুর মোর্শেদ, জেবউননেছা, জেরিন লুবানা ও আইনুল হাসান লিখিত ‘ইনক্লুসিভ সিটি অ্যান্ড আরবান পলিটিক্স: ইনফরমালিটি অব ব্যাটারি-বাইক ইন খুলনা, বাংলাদেশ’ এবং নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, জেবউননেছা ও এম এম আসাদুজ্জামান নূর লিখিত ‘কোয়েস্ট ফর ইফেক্টিভ লোকাল গভর্নমেন্ট ইন্সটিউশন টু ইমপ্লিমেন্ট সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ইন বাংলাদেশ’-এ যথাক্রমে ২৩ শতাংশ, ৪৮ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ এবং ৫৮ শতাংশ চৌর্যবৃত্তির প্রমান পাওয়া যায়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমি যখন বিভাগের সভাপতি ছিলাম তখন আশরাফুল হক অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে পূর্ণমেয়াদে কাজ করতেন। সেসময় এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর যায়। ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নেন। তাঁর ধারণা আমার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি চলে গিয়েছে। এ জন্য শত্রুতাবশত আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনেছে।’

বিভাগের অন্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে করা তাঁর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির যে অভিযোগ আনা হলো, সেটি টার্নিনিন সফটওয়্যারের পরীক্ষার ভিত্তিতে। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে যেকোন গবেষণা প্রবন্ধের “নকল” ধরা পড়বে। কারণ, টার্নিনিন সফটওয়্যার রেফারেন্স দিলেও চৌর্যবৃত্তি হিসেবে ধরে। বিভাগের অন্য শিক্ষকেরাও যে একইভাবে গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন সেটি প্রমাণ করার জন্য এসব অভিযোগ দিয়েছি। আসলে কারও প্রবন্ধেই চৌর্যবৃত্তি হয়নি।’

লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি জেবউননেছা বলেন, ‘আমার সাবেক সহকর্মী আশরাফুল হক তাঁর চাকরী চলে যাওয়ার পর আমার আরেক সহকর্মীর বিরুদ্ধে রাগের বশে অভিযোগ করেন। পরে নিজেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং অভিযোগ তুলে নিয়েছেন। বিষয়টি এখন পুরোপুরি সমাধান হয়ে গেছে।’

তবে হরে কৃষ্ণ কুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটিতে থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যপন্থী শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর এসব অভিযোগ নিয়ে সমঝোতা করে দিতে উপাচার্য তাঁর বাসভবনে ছায়েদুর রহমান ও জেবউননেছাকে নিয়ে বসেছেন। এই দুই শিক্ষকই উপাচার্যপন্থী শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে সমঝোতা চেষ্টার অভিযোগের ব্যাপারে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের কাছে জানতে চান সাংবাদিকেরা। এসময় উপাচার্য বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা সত্য যে আমি দু’পক্ষকেই বুঝিয়েছি অল্পবিস্তর অভিযোগ থাকলে তোমরা অভিযোগ থেকে সরে আসো। আমাদের সবাইকে ডেকে বসে বা তোমরা নিজেরাই পরস্পর কথা বলে এটা সমাধান করো।’

তাঁরা অভিযোগ থেকে সরে আসলে বা সমঝোতা করলে জালিয়াতি হয়নি এমনটা তো প্রমাণ হয় না, সেক্ষেত্রে তাদের বিচার হবে কিনা? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘আসলেই এটার মধ্যে রসদ আছে কিনা সেটা দেখার জন্য তো সময় প্রয়োজন। এটা আমার একার পক্ষে তো সম্ভব না। এটা দেখার জন্য কমিটি করে দিতে হবে। তখন তাঁরাই দেখবেন এখানে জালিয়াতি আছে কিনা। যদি বড় কিছু থেকে থাকে তাহলে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন