মো. আলী আশরাফ খান
ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এখনও এই ভয়ঙ্কর প্রথাটি বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে এবং বিভিন্ন পরিবারে। আমরা যতটুকু জানি, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। এর হাজারখানেক বছর পর থেকে এই প্রথা মিসর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষে। এর অনেক পরে চীনে এই কু-প্রথাটি জেঁকে বসে। ৮০০ হতে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশ গ্রিস এবং ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথার ভয়াবহ পদচারণা। এ যেন সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অসভ্যতার আর অমানবিকতার শীর্ষে উঠার প্রক্রিয়া! এভাবে প্রায় বিশ্বজুড়েই একসময় ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়াবহ কু-প্রথাটি।
শুরুতে ক্রীতদাস প্রথার বিস্তার কমই ছিল বলা চলে। তখনও কৃতদাসরা উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেনি। পরে মানুষ অমানবিকতার নতুন নতুন কৌশল শিখে নিয়ে ক্রীতদাসদের যারপরনাই অমানবিকভাবে খাটাতে শুরু করে। জানা যায়, ১৪৯৪ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস পাঁচশ রেড ইন্ডিয়ানকে দাস করে পাঠিয়েছিলেন স্পেনের রানী ইসাবেলাকে। কলম্বাস ওদের বদলে চেয়েছিলেন শূকর! রানী ইসাবেলা তার প্রস্তাবে রাজি হননি। ক্রীতদাসদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ১৭০০ সালে গিনিতে স্পেন আর পর্তুগাল তো রীতিমতো কোম্পানি খুলে বসেছিল ক্রীতদাসদের নিয়ে। তারা আমেরিকান আর ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বছরে দশ হাজার টন দাস সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মানুষও মাপা হতো টন হিসেবে, নিতান্তই সাধারণ মালপত্রের মতোই!
১৬৮০ থেকে শুরু করে মাত্র কুড়ি বছরে ইংরেজরা কম করে হলেও ১,৪০,০০০ মানুষকে রূপান্তরিত করেছিল দাসে। এই সময়কালে অন্যান্য ব্যবসায়ীও নিয়োজিত ছিল লাভজনক এই ব্যবসায়। তারাও দাসে পরিণত করেছিল ১,৬০,০০০ সহজ-সরল মানুষকে। চালাক-চতুর ব্যবসায়ীরা ওইসময় আফ্রিকায় গিয়ে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারিত করত। আফ্রিকার নানান গোত্রের দলপতিকে তারা দাওয়াতের মাধ্যমে ব্যাপক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করত। ওইসব দলপতিকে প্রদান করত নানা রকম বাহারি উপহার। উপহার পেয়ে সব ভুলে নিজ গোত্রের মানুষদেরই ক্রীতদাস বানাতে সহায়তা করত ওইসব মানুষরূপী দানবরা। প্রাচীন রোমে তো রীতিমতো আইনই করা হয়েছিল যে, দাসদের বিক্রি করা যাবে যার যার ইচ্ছা মতো! পরিসংখ্যান মতে, ১৮৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল ক্রীতদাস।
তখন দাস ব্যবসা সবচেয়ে রমরমা ব্যবসায় পরিণত হয় অনেকের কাছে। সোনার খোঁজে রেড ইন্ডিয়ানদের কাজে লাগানো হয়েছিল। দুর্ভাগা দাসেরা অবশ্য বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে বাধ্য হয় ওইসব অমানবিক অত্যাচার। যদিও কিছুকাল পরে তারা বিদ্রোহ শুরু করেছিল কিন্তু তা টেকেনি অমানুষদের তোপের মুখে। পরে আবারও বিদ্রোহ শুরু হলে ১৪৯৫ সালে কলম্বাস কঠোর হস্তে তা দমন করেন। আফ্রিকার উপকূলের পাশাপাশি দাস বিক্রির হাট বসত ব্রিটিশ বন্দরেও। এ ব্যবসাটি ছিল বেশ লাভজনক। উইলিয়ামথিমে নামক এক ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে জানা যায়, ১৬১৭ সালে তিনি একাই চালান দিয়েছিলেন ৮৪০ জন দাস। এই দাসদের কেউ কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ ছিল না, ছিল শ্বেতাঙ্গ। যুদ্ধবন্দিরা তো চিরকাল ধরেই নিগৃহীত, দাস হিসেবেও তাদের ব্যবহার ছিল যেন মামুলি ব্যাপার। ১৬৫২ সালে ডানবার যুদ্ধে স্কটিশ বন্দিদের মধ্যে ২৭০ জনকে বিক্রি করে দেওয়া হয় বোস্টনে। দাসদের মধ্যে সাদা-কালোর বালাই তখন উঠে গিয়েছিল। যেখানেই মুনাফা সেখানেই হাত বাড়াত লোভী সব ব্যবসায়ী।
১৭৫০ থেকে ১৭৫৫। এই পাঁচ বছরে এক নিউইয়র্কেই নাকি জাহাজ থেকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল রোগে-শোকে অত্যাচারে মৃত দুই হাজার শ্বেতাঙ্গ দাসের মরদেহ। মৃতদেহই যদি হয় দুই হাজার, দাসের সংখ্যা যে কত ছিল সে বলা মুশকিল। যুক্তরাষ্ট্রের খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হতো দাস বিষয়ক নানা রকম বিজ্ঞাপন। ১৭১৪ সালে তেমনি প্রকাশিত হয় একটি বিজ্ঞাপন। যাতে বলা ছিল, ‘ক’জন আইরিশ দাসী আর নিগ্রো বালক বিক্রি হবে!’ তারপর দেওয়া ছিল যোগাযোগ করার ঠিকানাও। ১৭৪৯ সালে বেরিয়েছিল একটি নিখোঁজ সংবাদ। বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়, ‘আইজাক ক্রমওয়েল নামে একজন নিগ্রো দাস আর একজন শ্বেতাঙ্গিনী দাসী গ্রিসে পালিয়ে গেছে, কেউ সন্ধান দিতে পারলে দেওয়া হবে পাঁচ পাউন্ড পুরস্কার’। চড়া দামে বিক্রি হতো ক্রীতদাস। সিজারের আমলে একজন দাসের দাম ছিল দশ পাউন্ড। আর সে যদি হয় সুন্দরী তা হলে দাম বাড়ত হু হু করে। একশ পাউন্ড মূল্যেও বিক্রি হতো সুন্দরী মেয়ে। তা সত্ত্বেও ধনী আর অভিজাত লোকেদের কমতি ছিল না দাসের। ইতালিতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ তে মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগই ছিল ক্রীতদাস। এই সংখ্যা বাড়তে থাকে দিন দিন। খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দে দেখা গেল দেশের অর্ধেক মানুষই ক্রীতদাস। ক্লডিয়াসের আমলে দাসের সংখ্যা যেখানে ২,০০,৮৩,০০০, সেখানে স্বাধীন মানুষের সংখ্যা মাত্র ৬৯,৪৪,০০০।
১৮০৮ সালের দিকে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় বহু দেশে। তারপরেও চোরাবাজারে হরদম বেচাকেনা হতে থাকে দাস নামে বহু মানুষ। দাসের চালান আসত জাহাজের খোলে ভরে। যাত্রার আগে দাসদের সবাইকে খোল থেকে বাইরে এনে মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে দাঁড় করানো হতো উলঙ্গ করে! তারপর মাথা মুড়িয়ে, লবণ মেশানো পানিতে শরীর ধুইয়ে বসানো হতো খেতে। দেওয়া হতো যৎসামান্য খাবার। এরপর বুকে সিলমোহর গরম করে ছেঁকা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হতো বিশেষ চিহ্ন। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর দাসের মালিক আরও একটি চিহ্ন বসাবেন কপালে, একই পদ্ধতিতে, তপ্ত সিলমোহর কপালে বসিয়ে! এভাবে অব্যক্ত যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে মানুষের গায়ে খচিত হতো ক্রীতদাসের চিহ্ন। এরপর একজনের পা আর একজনের পায়ে বেঁধে সারি সারি ফেলে রাখা হতো ক্রীতদাসদের। শিকলের আরেক প্রান্ত বাঁধা থাকত জাহাজের দেয়ালে, নড়াচড়ার উপায় ছিল না কোনোভাবে। দিনে দুবার দেওয়া হতো সামান্য খাবার আর পানি।
সামান্যতম প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেই গায়ে পড়ত নির্মম চাবুক। সপ্তাহে একদিন লোক আসত দাসদের নখ কেটে দিতে। কেউ যাতে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরতে না পারে কিংবা ধারালো নখ দিয়ে শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে না পারে, এই জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। মৃত্যু তো রুখতেই হবে, কারণ দাস ব্যবসা মানেই কাঁচা পয়সা, দাসের মৃত্যু মানেই লোকসান। জাহাজের খোলগুলো ছিল মাত্র দুই ফুট উঁচু। তার ভিতর অবিশ্বাস্যভাবে গাদাগাদি করে থাকতে হতো ক্রীতদাসদের। ১৮৪৭ সালে ‘মারিয়া’ নামের একটি জাহাজের পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ আর পঁচিশ ফুট চওড়া একটি খোলে পাওয়া গিয়েছিল ২৩৭ জন দাস। ‘ব্রুকস’ জাহাজের একশ ফুট লম্বা আর পঁচিশ ফুট চওড়া একটি খোলে ঢোকানো হয়েছিল ৬০৯ জন দাস। ব্রুকস-এর ক্যাপ্টেন খোলের ভিতর বসিয়েছিলেন আরও একটি তক্তা, তাতে দুই ফুট উঁচু খোলে ধরানো হয়েছিল দুই প্রস্থ মানুষ। সোজা হয়ে শোয়া তো দূরের কথা, পাশ ফেরারও উপায় ছিল না। এভাবে ব্রুক্সসের দাসদের থাকতে হয়েছিল টানা দশ সপ্তাহ। মল-মূত্র-কফ-থুথু-বমি সব জড়ো হতো ওখানেই।
এমন অনাচার সহ্য না করতে পেরে অনেক সময়ই আত্মহত্যা করতে চাইত ক্রীতদাসরা। তারা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত মরার জন্য। কিন্তু এত সহজে তো লোকসান দিতে রাজি নয় জাহাজের ক্যাপ্টেন। তাই প্রত্যেক জাহাজেই রাখা হতো বিশেষ একটি যন্ত্র, যার সাহায্যে দাসের ঠোঁট কেটে দাঁত ভেঙে পেটে নল ঢুকিয়ে খাইয়ে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হতো। একবার এক শিশু দাস কোনোমতেই খেতে রাজি না হওয়ায় চাবুক মেরে হত্যা করা হয় তাকে। তারপর ওই শিশুর মাকে বাধ্য করা হয় সন্তানের মৃতদেহটিকে সাগরের বুকে নিক্ষেপ করতে। শাস্তি দেবার জন্য খোলের ভিতর বন্দি দাসদের শরীরে নল দিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হতো ফুটন্ত পানি।
১৮৪৪ সালে ‘কেন্টাকি’ জাহাজের দাসরা বিদ্রোহ করলে নির্মমভাবে দমন করা হয় ওই বিদ্রোহীদের। কাউকে গলায় দড়ি দিয়ে, কাউকে গুলি করে মেরে কিংবা জীবন্ত অবস্থাতেই ¯্রফে সাগরের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এমনতর কাহিনীর যেন শেষ নেই কোনো। ‘ব্রিলান্ড’ জাহাজের ক্যাপ্টেন হোমানস দাস ব্যবসা করত লুকিয়ে-চুরিয়ে। কেননা তখন দাস ব্যবসাকে করা হয়েছে বে-আইনি। এমনই এক চালানের সময় তার জাহাজের পিছু নিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর চারটি জাহাজ। হোমানস দেখল মহাবিপদ, তার জাহাজের খোল ভর্তি ক্রীতদাস, ধরা পড়লে তো আর রক্ষা নেই। বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ৬০০ জন দাসকে পরপর মালার মতো বাঁধলেন একে অন্যের সাথে, তারপর জাহাজের সব বড় বড় নোঙর বেঁধে তাদেরকে ডুবিয়ে দিলেন সাগরের পানিতে। নৌ-বাহিনীর লোকেরা জাহাজ পরীক্ষা করে ফিরে গেল সন্তুষ্ট হয়ে। ওই জাহাজে কোনো ক্রীতদাস নেই! পেছনে পরে রইল ৬০০ মৃত মানুষের দেহ। তবে নানান সময়ে বিদ্রোহ করেছে ক্রীতদাসরা। সিসিলি দ্বীপের ইউনোস আর ক্লেওন-এর বিদ্রোহ, চীনের ‘লালভ্রু বিদ্রোহ’, ইতালির স্পার্টাকাসের রুখে দাঁড়ানোÑ এমন নানা রকম কথা শোনা যায় ইতিহাসে। এমন কি আমাদের সবার চেনা নাম ‘রাজিয়া’ যার পুরো নাম রাজিয়াত উদ্দিন, তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন দিল্লির মসনদে, দিল্লির মসনদে প্রথম মহিলা তিনি। এই সুলতানা রাজিয়ার পিতা ছিলেন একজন ক্রীতদাস। ইলতুতমিস। ইলতুতমিসের পূর্বসূরি কুতুবউদ্দিন আইবেকও ছিলেন একজন ক্রীতদাস, তিনিও বসেছিলেন দিল্লির মসনদে।
১৭৫৩ সালে কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মূল্য ছিল গড়ে পঁয়ত্রিশ পাউন্ড। ১৭৮৬ সালে লিভারপুলের একটি কোম্পানির ৩১,৬৯০ জন দাসকে বিক্রি করে লাভ হয়েছিল ২, ৯৮,৪৬২ পাউন্ড। দাম দিন দিন বাড়তে থাকে দাসদের। ১৭৮০ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের দাম ছিল যেখানে দু’শ ডলার, সেটি ১৮১৮ সালে হয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ডলার, ১৮৬০ সালে দাম বেড়ে হয় আঠারোশ’ ডলার। এমন লাভজনক ব্যবসাকে হারাতে চায়! এ জন্য ১৫১৯ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে আফ্রিকা থেকে দাস আনা হয়েছে কমসে কম ৫০,০০,০০০। মানুষ বেচাকেনার জন্য হাট-ও তো চাই। এথেন্স, রোমের পাশাপাশি দিল্লি, গোয়া, কলকাতা, হুগলিতেও বসত ক্রীতদাসের হাট। দিল্লিতে যখন চৌদ্দ সের গমের দাম তিন আনা, তখন একজন ক্রীতদাস শ্রমিকের দাম ছিল দশ-পনের টাকা। দাস যদি হয় শিক্ষিত-সুদর্শন বালক তা হলে তার মূল্য কুড়ি টাকা। রূপসী মেয়ে দাসের দাম বেশি, কুড়ি থেকে চৌত্রিশ টাকা। দারিদ্র্যের চাপে পড়ে কিংবা ঋণ শোধরাতে না পেরে অনেকে তাদের নিজেদের বিক্রি করে দিত দাস হিসেবে।
১৮৬২ সালের হিসাবে আসামে ছিল ২৭,০০০ দাস, চট্টগ্রামে ছিল ১,২৫,০০০ দাস। দাম ছিল গড়ে কুড়ি টাকা। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দাস ছিল এখানকারই নিজস্ব অধিবাসী। কিছু বিদেশি ক্রীতদাসও আসত। কলকাতাতে প্রতিবছর আসত প্রায় ১০০ ভিনদেশি দাস। ১৮৩০ সালের এক সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অযোধ্যার নবাব চড়া দামে কিনেছিলেন ৫ জন সুন্দরী বিদেশি মেয়ে আর ৭ জন ভিনদেশী পুরুষ। দাম পড়েছিল কুড়ি হাজার টাকা। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিলÑ ‘কলকাতা নিবাসী এক ভদ্রলোকের জন্য দুটি তামা বর্ণের সুন্দরী আফ্রিকান রমণী চাই’। পলাতক ক্রীতদাস ধরে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণারও নজির রয়েছে অনেক। ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব তো রীতিমতো নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে কোনো দাস কেনার সময় আদালতে রেজিস্ট্রি করাতে হবে। কলকাতায় এই ফি ছিল দাসপ্রতি ৪ টাকা ৪ আনা। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দাসই হয় দুর্ভিক্ষের কারণে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছিল অথবা ছিল নিচু শ্রেণীর মানুষ, কিংবা ছেলে ধরার হাতে ধরা পড়া বাচ্চারা। বাংলার সুলতানেরা অবশ্য আফ্রিকা, তুর্কিস্তান, পারস্য আর চীন থেকেও কিনে আনাতেন দাস। ১৮৩০-এর শতকের শেষভাগে আফ্রিকা থেকে আনা ‘হাবসী’ আর ‘কাফ্রি’ ক্রীতদাসদের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। হিন্দু সমাজে টাকা দিয়ে কেনা দাসদের ডাকা হতো ‘ক্রীতদাস’ বা ‘দাস’ নামে আর মেয়ে ক্রীতদাসের নাম ছিল ‘দাসী’। মুসলিম সমাজে পুরুষ ক্রীতদাসদের নাম ছিল ‘গোলাম’ বা ‘নফর’ আর মেয়ে ক্রীতদাসের পরিচয় ছিল ‘বাঁদী’ নামে। তাছাড়া সুন্দরী বাঁদীদের দাম আর চাহিদাও বেশি। মহাজনদের দেনা শোধ করতে না পেরেও অসংখ্য মানুষ নিজেদের বিক্রি করে দিত দাস হিসেবে। সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম আর ঢাকা অঞ্চলে ১৮৩৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ওখানকার এক-পঞ্চমাংশ মানুষই ছিল ক্রীতদাস। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এসে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হতে থাকে। আমাদের এই অঞ্চলে ১৮৪৩ সালের পাঁচ নম্বর অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের পথটি সুগম হয়।
কাগজে-কলমে ক্রীতদাস প্রথা এখন আর নেই। কিন্তু ধনী মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আজীবন ধরে ঋণগ্রস্ত থাকার প্রক্রিয়া চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকার অনেক দেশের এমন প্রথাকে বলা যেতে পারে নতুন মোড়কে ক্রীতদাস প্রথা। তা ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আচরণ এখনো অনেক দেশেই ক্রীতদাস প্রথাকেও হার মানায়।
যেসব অতীত ঐতিহ্য-নিদর্শন দেখে বিশ্ববাসী মোহিত হয়, হয় বিমুগ্ধ তার অনেকগুলোতেই লেগে আছে ক্রীতদাস শ্রমিকের ঘাম আর রক্ত রক্তের দাগ। ভারত আর রোমের অনেক স্থাপত্য, বিখ্যাত সব রাস্তা, থিয়েটার হল, চীনের গ্রেটওয়াল, মিসর আর মেক্সিকোর পিরামিডÑ এসব কিছুই নির্মিত হয়েছে ক্রীতদাসদের শ্রমে। এসব স্থাপত্যের প্রতিটি গাঁথুনিতে মিশে আছে ক্রীতদাসের হাহাকার। এসব চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সভ্যতা মানে শুধু ঝলমলে আলোই নয়, কখনও কখনও নিকষ কালো ভয়াবহ অন্ধকারও।
সবশেষে যে কথাটি বলা জরুরি, পরিবার, সমাজ, দেশ-জাতি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে এখন যে কাজের লোক নিয়োগ দেওয়ার প্রথা চালু রয়েছে, তাদের ওপরও কৃতদাসদের মতোই আচরণ করতে দেখা যায়। যদিও আমরা দাবি করি, আমরা আধুনিক হয়েছি, আমাদের মধ্যে সভ্যতা এসেছে। আসলে কি তাই? কাজের লোক তথা অধীনস্থদের ওপর যে অমানবিক আচরণ করা হয় তা দাসপ্রথার চেয়ে কোনো অংশে কম কি? এসব ভয়াবহ ঘটনার দু-চারটি মানুষ জানতে পারে-প্রকাশিত হয়। কিন্তু অগণিত ঘটনাই থেকে যায় আমাদের জানার বাইরে। যা এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ বিশ্বব্যাপী ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের আত্মসমর্পণ। আর তবেই প্রকৃত শান্তিতে বসবাস করতে পারবে পৃথিবীর সব শ্রেণির মানুষ।
লেখক : কবি, সংগঠক
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন