রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

আমরা ও আমাদের সংস্কৃতি

প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল বাসেত
সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটি দেশ, সমাজ ও জাতিকে অন্য জাতি থেকে আলাদা করা যায়। কিন্তু সেই সংস্কৃতিই যদি হয় অন্য সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ তাহলে সেখানে থাকে না কোনো স্বাতন্ত্র্য, স্বচ্ছতা ও স্বকীয়তা। যেখানে প্রয়োজন নিজের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে জানান দেয়া সেখানে নিজের সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতিতে বিলীন করে দেয়া নিছক হীনমন্যতা, বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। যদিও সংস্কৃতির সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় আজ পর্যন্ত দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ ও মনীষীরা একমত হতে পারেননি তবুও সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাকলভারের ভাষায়, সংস্কৃতি হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। আমরা প্রতিদিন যে ভাবনা চিন্তা করি এবং শিল্পসাহিত্য ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেসব কর্মপন্থা অনুসরণ করি আর আমোদ-প্রমোদ ও জীবন উপভোগের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করি- সংস্কৃতির মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটে। মূলত ব্যক্তি বা জাতির ভাষা সাহিত্য, আচার-আচরণ, কর্ম, অভ্যাস, রুচিবোধ ইত্যাদি যা আছে তাকে ঘষামাজা করে আরো রুচিশীল, মার্জিত ও শালীন করার প্রচেষ্টাই হলো সংস্কৃতির চর্চা। অনেকেই আবার সংস্কৃতির সাথে ধর্মের একটু বিরোধ তৈরি করতে না পারলে মনে করেন, সংস্কৃতি সাধনার পূর্ণতাই পাওয়া যায় না যা নিতান্তই গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা। অথচ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের ভিতরকার সকল সংকীর্ণতা দূর করে নিজেকে আগে চেনা আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় আমাকে যেতে হবে, কি আমার উদ্দেশ্য, নিজের ভিতরে স্বীয় স্রষ্টাকে জাগ্রত করা ও চিনতে চেষ্টা করা। সংস্কৃতিবান মানুষ মানবতার সেবা ও সমাজ উন্নয়নে নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত করে যাতে কোনো প্রকারের মোহ, স্বার্থপরতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এখানেই, আমাদের ছোট্ট শিশুমণিরা মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ভাষাকে যখন ভিনদেশীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে গ্রহণ করে আরো পরিতাপের বিষয় আমাদের অভিভাবকেরা যেন শিশুদের স্বদেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করাতে হীনমন্যতা ও লজ্জাবোধ করেন। সংস্কৃতি চর্চার অনেক প্রাণপুরুষকেও এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের কাতারে দেখা গেছে।
সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে কবি জসিমউদদিনের ‘কবর’ ও আল-মাহমুদের ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতার মত প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ, শোক, আবহমান গ্রামবাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ ইত্যাদির চিত্রায়িত করার পরিবর্তে এখনকার সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে উঠেছে প্রেম-ভালোবাসার নামে বেহায়াপনা ও নোংরামি যা আমাদের সংস্কৃতিকে করছে কলুষিত। আকাশ-সংস্কৃতির পাল্লায় পড়ে আমরা হারিয়েছি আপন সংস্কৃতিকে। পাঞ্জাবি-পায়জামা, শাড়ি-লুঙ্গি ইত্যাদির পরিবর্তে আঁটসাঁট ও স্বল্প-বসনা আজ গ্রামবাংলায়ও ঠাঁই নিয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিকে দারুণভাবে আঘাত হানতে শুরু করেছে ‘পাশ্চাত্য সংস্কৃতি’। নাইট ক্লাব, ডিজে পার্টিতে নেশার আড্ডার সাথে দেহব্যবসা ছড়িয়েছে রাজধানীসহ সারাদেশে। কেবল অনৈতিক কাজই নয়Ñ হেরোইন, গাঁজা, মদ, ইয়াবাসহ সব রকমের মাদক ব্যবসা। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ১২ অক্টোবর ২০১৪-এর ‘বিপথগামী তরুণ প্রজন্ম’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সরকারের সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রহস্যজনক নীরবতার সুযোগে রাজধানীর প্রায় ৭৫টি স্পটে ৪ শতাধিক হোটেল, ৩২ সহস্রাধিক বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাটে চালিয়ে যাচ্ছে জমজমাট দেহব্যবসা। আর এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।’ প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের সংস্কৃতি শেষটুকুর উপরও কালো হাত বসিয়েছে। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ছোট বড় প্রায় সকলেই এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। যে প্রযুক্তির ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে ফুটিয়ে তোলার জন্য- তা ব্যবহৃত হচ্ছে নানা অপকর্মে।
যে কোনো সংস্কৃতিকে স্বজাতির মাঝে উপস্থাপনের অন্যতম মাধ্যম ‘মিডিয়া’। শহর থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে পৌঁছিয়েছে টেলিভিশন। টেলিভিশনের কাজই হলো ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাতির সামনে তুলে ধরা। সেখানে সংস্কৃতি চর্চার নামে এমন কিছু নাটক, সিনেমা সম্প্রসারিত হচ্ছে যা শুধু অপসংস্কৃতিই নয় এর কুপ্রভাবও পড়ছে আমাদের সমাজ জীবনে। ভিনদেশী নাটক-সিনেমা সম্প্রচার যা শুধু আমাদের সংস্কৃতিকে অপমানই করে না, উপযোগিতা কমাচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চাকে।
আমাদের সমাজ এই অপসংস্কৃতিকে ধারণ করতে গিয়ে পারস্পরিক ভালোবাসা, সহমর্মিতা, বিশ্বস্ততা ও নৈতিকতা হারাচ্ছে। সংস্কৃতি হতে হবে স্বনির্ভর। ধার করা সংস্কৃতি কাল-পরিক্রমায় আসল সংস্কৃতিকে মুছে দিতে পারে যা কাম্য নয় এবং জাতি হিসেবে অপমানকর। রবাট রেডফিল্ড (১৯৫৬) মনে করতেন, পৃথিবীতে কিছু আদিম গোত্র বাস করে, যারা স্বনির্ভর এবং যাদের বাইরের জগৎ থেকে কিছুই নিতে হয় না। ফলে তাদের সংস্কৃতিও স্বনির্ভর। তিনি বলেন, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের গোত্রাদি বিশেষ করে ‘জারওয়া’ গোত্র যারা তখনও অন্য জাতির সংস্পর্শ পায়নি, তাই তারা স্বনির্ভর।
একই জাতিসত্তা হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ ও নগরবাসীর মাঝে রয়েছে সংস্কৃতিগত ব্যাপক পরিবর্তন। গ্রামীণ জীবনে পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা, সৌহার্দ্য আন্তরিকতা ও সহযোগিতার যে সম্পর্ক রয়েছে শহুরে জীবনে তা অনুপস্থিত। এখানে প্রত্যেকে আত্মকেন্দ্রিক, অনেকটা বলা যায় স্বার্থপরের মতো। বাস্তবতা এমনই, একই বাড়ির পাশাপাশি বসবাসরত দুই ফ্ল্যাটের এক পরিবার অপর পরিবারকে চেনে না, জানে না। এমন কি জানার আগ্রহও প্রকাশ করে না। কেউ কারও বিপদে এগিয়ে আসার দৃষ্টান্ত কমই পাওয়া যায়। শহরের অধিবাসীদের মাঝে ভিনদেশীয় সংস্কৃতির প্রভাব অত্যধিক। আবার শহুরে জীবনেও বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এখানে যেমনি রয়েছে উচ্চ পরিবার তেমনি রয়েছে সর্বনিম্ন পরিবারও যা তাদের বাহ্যিক পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহারেও পার্থক্য সৃষ্টি করে।
আমাদের সংস্কৃতিতে আরেক থাবা গ্রাস করেছে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার মানসিকতা। বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি ও আসবাবপত্র না হলে যেন সমাজে টিকে থাকাই ব্যর্থ। এ প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে গিয়ে সমাজে সর্বস্তরে চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান ইত্যাদি যেমনিভাবে বেড়েছে তেমনি শিক্ষিত উচ্চশ্রেণির লোকেরা জড়িয়ে পড়েছে সুদ, ঘুষ ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকা-ে। সুস্থ সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা ও সুস্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অবৈধ ও অনৈতিক আর্থিক কর্মকা-ের জন্য সাময়িকভাবে ব্যক্তি লাভবান হলেও সমাজের অন্য লোকদের ক্ষতি সাধন হয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের সংস্কৃতিতে ভিনদেশীয় প্রভাব যেমনি বেড়েছে, তেমনি জ্ঞান-বুদ্ধি, কলা-কৌশল ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রবাহও লেগেছে। এক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতির সাধক ও সংস্কৃতবানদের আরো এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন