বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

গণহত্যা রোধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে

প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
৪০ বছর আগের ঘটনা। মার্কিন সভ্যতার নমুনা আছড়ে পড়ল ভিয়েতনামের মাটিতে। নাপাম ফাটাতেই চারিদিক অন্ধকার। দাউ দাউ করে জ্বলছে গ্রাম। দৃশ্যমান হল ধোঁয়ার কু-লিকে পেছনে ফেলে প্রাণ বাঁচাতে রাস্তায় ছুটছে কয়েকজন শিশু। তারমধ্যে সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে চিল চিৎকার করে দৌড়চ্ছে ৯ বছরের কিম ফুক। সারা দেহ ঝলসে গিয়েছে। বাঁচার আর্তি ফ্রেমবন্দি করলেন ২১ বছরের চিত্রগ্রাহক নিক উট। জনসন-নিক্সনদের নৃশংস মানবতার ছবি জয় করে নিল পুলিৎজার।
‘Holocaust’ একটি পরিচিত শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ব্যাপকভাবে সংঘটিত হত্যাকা-। কিন্তু কেন? কোথায়? একেই কি বলে সভ্যতা। প্রশ্নগুলো সহজ অথবা কঠিন। উত্তর খুঁজতেই এই ফিরে দেখা। উত্তর খুঁজতে গেলে মন ভারাক্রান্ত হতে বাধ্য। যে নামেই নারকীয়তাকে চিহ্নিত করা হোক না কেন, নিট ফল কিন্তু মানবের ক্ষতি। সব জেনেও সেই ক্ষতির ঘটনা ঘটেই চলেছে। ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার বা বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার ধারালো ফলায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মানুষ। অথচ এসব বন্ধ করার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকলেও কিন্তু তা মানছে না আগ্রাসী মনোভাবের দেশগুলো। ফলে অনিবার্য হচ্ছে সংঘাত। দিনে দিনে পুষ্ট হচ্ছে ক্ষতির খতিয়ান। মানবতার ধ্বংস দেখে যেমন লজ্জায় শুভবুদ্ধির মানুষের মাথা হেঁটে যায়, তেমনি উন্নত শির প্রমাণে নির্লজ্জ হয় শাসকরা।
ইউরোপীয় খ্রিস্টান নাইটদের জেরুজালেমকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১০৯৫ থেকে ১২৭০ অবধি চলল দীর্ঘ crusade। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ এবং চল্লিশ-এর দশকে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদির ভয়াবহ মৃত্যু হয় জার্মানির তৎকালীন ঘধুর সরকারের হাতে। কত লক্ষ লোক সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রগুলোতে অত্যাচারের বলি হয়ে জীবন হারালো তার ইয়ত্তা নেই।
১৯৩৯ সালে বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির জনজীবন। ১৯৪৭ সালে ভারত যখন দ্বিখ-িত হল কত মানুষ চিরকালের জন্য হারালো নিজের ঠিকানা। ১৯৬৫-১৯৭৫ ব্যাপী আমেরিকা অজস্র সৈন্য পাঠাল ভিয়েতনামে। সংখ্যাহীন নিরপরাধ মানুষের নিভে গেল প্রাণ। যুদ্ধশেষে পরাজিত আমেরিকান সেনার একটা বড় অংশ তাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। চালু হল একটি নতুন রোগ- Vietnam Syndrome|।
১৯৫৪ সালে জেনেভা শান্তি সম্মেলনের পরই বিশ্বের বড় তিন শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েতনামের উপর চাপ দিতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করে ফেলা। বলা হয়, এটা অস্থায়ী ব্যবস্থা। ১৯৬৫ সালে ফের জুড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। শান্তিচুক্তিতে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সব রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে ওয়াশিংটন ভিয়েতনামের দক্ষিণ অংশকে কব্জা করে। শুরু হয় উত্তরকে ধ্বংস করার কাজ। ১৯৭৫ সালে লড়াই থামলে দেখা যায় ৪০ হাজার ভিয়েতনামির মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন সেনা মরেছে ৫৮ হাজার। ২ কোটি ৩০ লক্ষ বোমা ব্যবহার হয়েছে। ৭ কোটি ২০ লক্ষ টাকার রাসায়নিক ব্যবহার হয়েছে। এখনও ১৩ শতাংশ ভিয়েতনামী যুদ্ধের চিহ্ন বহন করছে শরীরে। এই গণহত্যা কি এড়ানো যেত না।
ইরাকের ক্ষেত্রেও যা ঘটেছে তা এক কথায় নারকীয়। ১৯৪১-৪৫ সালে হিটলার হত্যা করেছিল ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে। ১৯৯০-২০০৯ সালে মার্কিন প্রশাসন ইরাকে হত্যা করেছে প্রায় ৩২ লক্ষ মানুষ। এরমধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু ১০ লক্ষ। বি রাসেলস ট্রাইব্যুনালের হিসাব মতো ৬ লক্ষ ইরাকি শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। এর কোনও প্রয়োজন ছিল কি? এত ঘটনার পরও আমেরিকা নিজেদের সভ্যতার ঢাক পেটায় নির্লজ্জতার সঙ্গেই। প্যালেস্টাইনেও গণহত্যার চিত্র ভয়াবহ। মায়ানমারে কি হচ্ছে? রোহিঙ্গাদের রক্তে রাজপথ আজ রঞ্জিত হচ্ছে, তাদের ভিটা বাড়ি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। ধর্মীয় স্থান ভেঙে চুরমার করা হচ্ছে, ধর্মকর্মে বাধা দেয়া হচ্ছে, অথচ জাতিসংঘের মতো একটা মহান সংস্থা এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া বা মিশরে কি হচ্ছে বা কার দ্বারা হচ্ছে তা সবারই জানা। নিরীহ নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে অস্ত্র এবং পরামর্শ দাতারা ডলার গুনছে আর হাসছে। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই তো লাভ তাদেরই। মিশরে  যা ঘটছে তার জন্য দায়ী কে সবইতো একই দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই হচ্ছে। ফায়দা হাসিল করছে তারা। মানবাধিকার দেশে কলঙ্কিত হচ্ছে কেউ কথা বলছে না। যতক্ষণ তাদের উপর আঘাত না আসে তারা থাকে নীরব। ক’ জন ইসরাইলী প্যালেস্টাইনদের দ্বারা  মারা  গেলে শুরু হয় চিৎকার। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নেয়া হয় শপথ। হত্যা করা হয় নিরীহ প্যালেস্টাইনীদের। পশ্চিমারা তখন থাকে নীরব। পাখীর মত প্যালেস্টাইনীদের হত্যা করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তারা বলে থাকেন ইসরাইলীদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি প্যালেস্টাইনীদের তাদের নিজস্ব ভূমিতে বেঁেচ থাকার অধিকার নেই?
বলতে দ্বিধা নেই গণহত্যার বিশ্বরেকর্ড তৈরি করেছে জার্মান এবং আমেরিকা। কিন্তু নিজেদের দিকে তাকালেও লজ্জা পেতে হয় এই ভেবে যে, একই দোষে আমরা কি দোষী নই। পাক, ভারত, বাংলাদেশে কত নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে। এসব অবৈধ অস্ত্র আসে কোথা থেকে- সরবরাহ করেই বা কে? অবৈধ এসব অস্ত্রের সরবরাহ কি বন্ধ করা যায় না? সরবরাহকারীদের কি আমূলে উৎখাত করা যায় না ?
সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় নৃশংস খুনের পাতাভরানো বীভৎস কাহিনী যা দিনে দিনে চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। আমরা সবাই আতঙ্কিত ও হতাশ; তৈরি হচ্ছে আত্মরক্ষার মারাত্মক ভীতি ও আশু সমাধানের পথ-অন্বেষণ; অজান্তে, অবচেতনে ঘটে চলছে হিংস্র ঘটনার অনৈচ্ছিক অনুশীলন- যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে আচার-আচরণে হিংস্রবৃত্তির অস্বাস্থ্যকর নারকীয় বহিঃপ্রকাশ। ‘Violence beget violence’ তাই হিংসাকে প্রীতি ও ভালোবাসা দিয়ে বশে আনতে হবে নতুবা কারণ সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই অদূর ভবিষ্যৎ-এ human-existence  হবে বিপন্ন।
পৃথিবীতে পরিবারে, সমাজে, ধর্মে, জাতিতে জাতিতে নিরন্তর বিবাদ নিত্যনতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। অধিকাংশ মানুষ বা দল চায় ভোগ্যবস্তু, যৌন উপকরণ, যশ, ক্ষমতা ইত্যাদি নিজের বা নিজের দলের অধিকারে রাখতে। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আদর্শগত, বিশ্বাসগত, সাংস্কৃতিগত ব্যবধান ও ভিন্ন মতামতসঞ্জাত অসহিষ্ণুতা ও অনুদার সংকীর্ণতা থেকেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সংঘর্ষের পরিবেশ গড়ে উঠে। মত ও রুচির ভিন্নতা মানুষে-মানুষে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সন্ত্রাসের বাতাবরণ গড়ে তোলে সে প্রসঙ্গে শেষের কবিতা’য় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “যা আমার ভাল লাগে তাই আর একজনের ভাল লাগে না, এটা নিয়েই পৃথিবীতে যত রক্তপাত।”
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন