রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

বাংলাদেশের স্বার্থও দেখা উচিত

প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবি সিদ্দিক
গত ১৬ জুন থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো নৌ-ট্রানজিট। এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ জুড়েই ভারত সড়ক যোগাযোগ সুবিধা পাচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগ পশ্চিমে চালু হয়েছে এবং ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে আরেকটি সংযোগ লাইন হচ্ছে। অপরদিকে ভারত চট্টগ্রামের কুতুবদিয়া দ্বীপে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই টার্মিনাল ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বোতল-গ্যাস সরবরাহ করতে চায়। সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জ্বালানি সচিব পর্যায়ের এক বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গোটা পূর্ব ভারতে গ্যাস গ্রিড নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মিয়ানমার থেকে ভারতে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে বাংলাদেশও যাতে তার একটা অংশ পেতে পারে বলে একখানা টোপ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশও রাজি আছে এতে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে ভারতের সঙ্গে পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ স্থাপনের ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ গ্রিড অনেকটাই ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
এশিয়ান হাইওয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। সমগ্র এশিয়ার সাথে যোগাযোগের নিমিত্তে এই ধারণার উদ্ভব হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি কায়েমি স্বার্থবাদীদের নজরে পড়েছে। ফলে এশিয়ান হাইওয়েতে বাংলাদেশের যোগদান দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকির আশঙ্কা তৈরি করেছে। এশিয়ান হাইওয়েতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য তিনটি রুটের উল্লেখ থাকলেও সর্বশেষ ইন্টারনেট সংস্করণে দুটি রুটের উল্লেখ পাওয়া গেছে। এএইচ-১ নামক প্রথম রুটে বেনাপোল-যশোর-ঢাকা-কাঁচপুর-সিলেট-তামাবিল এবং এএইচ-২ নামক রুটে বাংলাবান্ধা-হাটিকুমরুল-ঢাকা-কাঁচপুর-সিলেট-তামাবিল রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ-মিয়ানমার সড়কটি আঞ্চলিক রুট এএইচ-৪১ নামে পরিচিত। দেশের স্বার্থ এই রুটে বেশি অর্জিত হবে বলে তৎকালীন সরকার এই রুটকে আন্তর্জাতিক রুটের মর্যাদায় আনার চেষ্টা করে। কিন্তু বিষয়টির কোনো সুরাহা না হওয়ায় চারদলীয় জোট সরকার দেশের স্বার্থে বাকি দুই রুট প্রত্যাখ্যান করে। এশিয়ান হাইওয়ের দ্বারা বাংলাদেশের স্বার্থ যতটুকু না রক্ষা হবে তার চেয়ে বেশি স্বার্থ রক্ষা হবে ভারতের। কারণ এএইচ-১ বা এএইচ-২ যে রুটই বাস্তবায়ন করা হোক না কেন এর দ্বারা পক্ষান্তরে ভারত তার কাক্সিক্ষত করিডোর পেয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এটা এশিয়ার যোগাযোগের ডামাডোলের আড়ালে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো নিয়ন্ত্রণের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যদিও ভারত ১৯৭২ সাল থেকেই পানিপথে করিডোর পেয়ে আসছে ওহষধহফ ধিঃবৎ ঃৎধহংরঃ ধহফ ঃৎধফব চুক্তির মাধ্যমে। এই চুুক্তি স্বাক্ষরিত হয় জিয়া সরকারের শাসনামলে ১৯৮০ সালে এবং নবায়ন করা হয় অবৈধ ফখরুদ্দীন সরকারের সময়ে ২০০৮ সালের মে মাসে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে স্বাধীনতার দাবিতে যে আন্দোলন চলছে তা দমন করতেই ভারতের দরকার দ্রুততম সময়ে ওই ৭ রাজ্যে সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করা। কিন্তু নিজেদের সীমানা দিয়ে যেতে অতিরিক্ত ৫০০ কিমি ঘুরতে হবে। আর এ জন্যই ভারত সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধানে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে যেতে চায় এবং এ জন্যই ওই রাজ্যগুলোতে যেতে এশিয়ান হাইওয়ে নিয়ে এত উদগ্রীব।
কলকাতা থেকে এখন ঢাকা পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে। ভারতের লক্ষ্য কলকাতা থেকে ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ সৃষ্টি করা। ভারতীয় রেলের সাথে মিল রেখে মিটারগেজ লাইনের পরিবর্তে এখন ডুয়েল গেজ লাইন করা হচ্ছে, যাতে ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে করিডোর হলে ভারত সে সুযোগ নিতে পারে।
আর আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এডিপিতে ভারতীয় ঋণে রেলওয়ের মোট ১০টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় ঠিকাদারের ব্যর্থতায় একটি প্রকল্প আড়াই বছর পর সমাপ্ত ঘোষণা (বাতিল) করা হয়। বাংলাদেশের চাহিদানুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদাররা ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রেলওয়ের ১০ সেট ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট সংগ্রহ প্রকল্পটি দুই বছর পাঁচ মাস পর অসমাপ্ত অবস্থায় সমাপ্ত ঘোষণা করে সরকার।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্পূর্ণ সরকারি টাকায় ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তথ্যানুযায়ী ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত কোনো ধরনের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি না হওয়ায় চার বছর পর এসে প্রকল্পটি সংশোধন করে ভারতীয় ঋণের টাকায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি সংশোধনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী ভারতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রেলের গেজ একত্রীকরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান মিটারগেজ ট্র্যাক (এমজি) করা হচ্ছে। এই লাইনটি ভারতের বর্ডারের সাথে শাহবাজপুর বর্ডার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। ফলে লাইন নির্মাণকাজ অনুমোদিত প্রকল্পের কাজের চেয়ে ৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার বেড়ে গেছে। প্রকল্প ব্যয় এখন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াচ্ছে ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যার মধ্যে ভারতীয় ঋণের আওতায় পাওয়া যাবে ৫৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বাকি ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারকে ব্যয় করতে হবে।
ভারত তার বৃহত্তর স্বার্থে একে একে বাংলাদেশের কাছ থেকে সব সুবিধা আদায় করছে। এক রাজ্যের বিদ্যুৎ অন্য রাজ্যে নেয়ার জন্য বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযোগ পেল। ত্রিপুরা রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ গ্রিডের পাশাপাশি গ্যাস লাইনের সংযোগ। মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের জন্য সড়ক ও রেল সংযোগ। একই উদ্দেশ্যে নৌ-ট্রানজিট। কিন্তু বাংলাদেশ কী পাচ্ছে বা পেয়েছে? তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে, এমন কোনো সম্ভাবনা আর নেই। আর এখন বা ভবিষ্যতে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ পানি পাবে না। কারণ, তিস্তায় ভারত একের পর এক বাঁধ দিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার পানি বাংলাদেশ পাচ্ছে না। পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এতে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলো। এরই মধ্যে এ অববাহিকায় শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। চরম হয়ে উঠছে এ অঞ্চলের জলবায়ু। বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। শুরু থেকেই ফারাক্কা ইস্যুতে সরব বাংলাদেশ। আন্দোলন করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও। তবে ভারতের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে কাজের কাজ হচ্ছে না। অভিন্ন ৫৪ নদীতে আগেই বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অন্তত পানির ন্যায্য হিস্যাটুকু আদায় করা দরকার। একপক্ষ শুধু একক সুবিধা নেবে আর বাংলাদেশ কিছুই পাবে না- এটা কেমন নীতি?
লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন