১৪ নভেম্বর তিতুমীরের মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে
এই বাংলার বুকে সুদূর অতীতে জন্ম হয়েছিল স্বনামধন্য এক বীরের। যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় দূর্ভেদ্য প্রতিরোধ ও গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ইংরেজরা যার নামে শঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়তো। আমি সেই বাংলার বীর তিতুর কথাই বলছি। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। তিতুমীরই সর্বাগ্রে বাংলার একাংশে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
তিতুমীরকে জানতে হলে শত শত বছরের ব্যবধান পার হয়ে সুদূর অতীতে ফিরে যেতে হবে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদের আগুন সর্বপ্রথম পূর্ণশক্তিতে জ্বলে উঠে এই বাংলার বুকে। জমিদার, ইউরোপীয় নীলকর এবং ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটা গণআন্দোলন পরিচালনা করেন তিতুমীর। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিতুমীরের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে।
সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসতপুর মহকুমার অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল সৈয়দ মীর হাসান আলী আর মা’আবেদা রোকাইয়া খাতুন। সৈয়দ মীর হাসান আলী ছিলেন বারাসাতের চাঁদপুর গ্রামের একজন সামান্য কৃষক। তিতুমীরের বাল্যকাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না। তিনি অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। ব্রিটিশ বেনিয়াদের অত্যাচারে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তখন জর্জরিত, নিষ্পেসিত। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর স্বচক্ষে বাংলার মানুষের হতভাগ্য নিরন্ন কৃষকের করুণ মুখচ্ছবি ও রুগ্ন চেহারা দেখে কৈশর থেকেই ব্যথিত হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁর মনে বিদ্রোহের অনল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ইংরেজ বেনিয়াদের উপর তার মনে প্রবল ঘৃণার সঞ্চার হয়। হতভাগ্য মুসলমানদের দু:খ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্ব পালন করতে যান। মক্কায় সৈয়দ আহমেদ বেরলেভির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয় এবং ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসার বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়। তিনি সৈয়দ আহমেদ বেরলেভির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পবিত্র মক্কায় হজ্ব শেষে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি এক জমিদার কন্যাকে বিবাহ করেন। নিজের স্বাচ্ছন্দ তুচ্ছ করে তিতুমীর স্বদেশের লোকের মর্মান্তিক দু:খ-দুর্দশা দুর করার জন্য কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়েন। এ সময় তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ মুসলমানদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর হৃদয়ে সে সময়ে প্রবল স্বদেশপ্রেম জেগে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেও একজন দক্ষ লাঠিয়াল ও কুস্তিগীর হয়ে উঠেন।
অজস্র বাঁশের সমাহার, বাঁশ বেড়িয়া গ্রাম। এখানেই তৈরী করেন তিতুমীর তাঁর বাঁশের কেল্লা। তিতুমীরের নিজের হাতে তৈরী এক আশ্চর্য বাঁশের কেল্লা। বাঁশের দূর্গ বলা যায়। সম্পূর্ণ বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরী। বলা যায় বাংলার এক অনবদ্য লোকজ শিল্প।
বাঁশ বেড়িয়া গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তৈরী হয়েছিল এই গড়। বৃহৎ বিস্তীর্ণ এক আম্রকানন। পলাশীর সেই আম্রকাননের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালির মনে। বলা যায় পলাশীর আম্রকাননের যুদ্ধক্ষেত্রের মতোই হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের আরেক সংগ্রামের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এই তিতুর দূর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা। চারদিক গড় কেটে বাঁশ পুতে দেয়া হয়েছিল। কেল্লার ভেতরটা একেবারে রাজপ্রাসাদের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ। সেখানে রয়েছে তিতুর খাস কামরা, দরবার কক্ষ, সৈন্যদের থাকার জন্য ব্যরাকের মতোই সারি সারি ঘর সাজানো। অগণিত সৈন্যবাহিনীর কোলাহল। ঘরে ঘরে প্রদীপের সমাহার। আলোকিত চারদিক। ঘরগুলোতে রাত্রি যাপন করতো তার সৈন্যরা। শাহী দরবার কক্ষে বসতো গণ আদালত, বিচার কার্য সমাধা হতো। অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা হতো দরবারে।
মক্কা থেকে ফিরে এসেই তিতু ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন দরিদ্র কৃষক, চাষী, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিগৃহীত শোষিত হচ্ছে অত্যাচারী ইংরেজ ও জমিদারদের যাতাকলে। তাই তিনি তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ডাক দিয়েছিলেন সংগ্রামের। তিতুমীরের এই একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রামের সিদ্ধান্ত বারাসতের ম্যাজিষ্ট্রের কানে পৌছে। তিনি দু’শ লাঠিয়াল ও পাইক, তিনশ’ সড়কি ওয়ালা এবং একজন দারোগাকে পাঠালেন তিতুমীরকে ধরতে। দারোগা তিতুকে ধরতে গিয়ে তাঁর হাতে প্রাণ হারালেন। দারোগার সঙ্গী-সাথীরাও অনেকে নিহত হলো। মারাতœকভাবে শত্রু সেনারা তিতুর হাতে আহত হলো অনেকেই। এই সাফল্যে তিতুর মনোবল আরো বেড়ে গেল। দিন দিন তাঁর সূখ্যাতি ও জনবল আরো বাড়তে লাগলো। দলে দলে লোক তিতুর পতাকা তলে সমবেত হতে লাগলো। অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার হয়ে উঠলো। তিতুর নাম-ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। গোবরাডাঙ্গা ও আশেপাশের আরো দু’তিন গ্রামের খাজনা আদায় করতে লাগলেন তিতুমীর। তখন ৭০০-৮০০ লোক তিতুমীরের আজ্ঞাবহ। তিতুমীর তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা। তারা তাঁদের নেতার কথায় হাসি-মুখে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। বাংলার স্বাধীনতার জন্য জীবন দান করতে পারে। বারাসতের কৃষকরা তিতুমীরের নেতৃত্বে ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তৎকালীন অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। এ সময় বাংলার বুকে ইংরেজ বলীয়ান বিখ্যাত জমিদার রামনারায়ণ বাবু (তারাগুনিয়া), কৃষ্ণদেব রায় (পূর্ণিয়া), গৌরপ্রসাদ চৌধুরী (নাগরপুর) ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী। প্রজাদের খাজনা আদায়ের জন্য তারা কৃষক ও সর্বশ্রেণির লোকদের উপর অত্যন্ত জুলুম করতেন। অত্যচারী কৃষ্ণদেব রায় জমিদার সেকালে মুসলমানদের দাড়ির উপর ট্যাক্স বসান। এতে তিতুমীর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ও রাগান্বিত হন। তিতুমীর কৃষ্ণদেবের জমিদারী আক্রমন করেন। তিনি পূর্ণিয়ার, পুড়ার কৃষ্ণদেবের জমিদারীর প্রভূত ক্ষতিসাধন করেন। সেখানে বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে গরু জবাই করেন। তিতুর আশপাশের এসব অত্যাচারী জমিদার একত্রে মুসলমানদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারী দখল করে নিতে থাকে। এতে তিতুমীর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হয়ে ওঠেন। তিনি সে সময় অত্যাচারী এসব জমিদারদের বিচারের জন্য তার সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মাসুদ কে ইংরেজ কালেক্টরের কাছে পাঠান। কিন্তু তিতুর সেনাপতি গোলাম মাসুদ ইংরেজ কালেক্টরের কাছে কোন সুবিচার না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসনে নিজ গ্রামে। এতে তিতুমীর ইংরেজ কালেক্টরের ওপর অত্যন্ত মনোক্ষুন্ন হন। তিতু ইংরেজদেরকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য তার সৈন্যদের সংঘবদ্ধ করেন। দেশপ্রেমের মন্ত্রে সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে থাকেন। তারা ইংরেজদের সম্পূর্ণ এদেশ থেকে বিতাড়িত করে বাংলার বুকে হৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য দৃঢ় সংকল্পে বলীয়ান হয়ে ওঠেন।
তিতুর সঙ্গে প্রথম যুদ্ধ করতে আসেন ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সঙ্গে পাঠান পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। সাহেবের হাতে বন্দুক। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর হাতের সড়কি ও বল্লমের অব্যর্থ নিশানায় ইংরেজ সাহেবের পক্ষের বহু পাইক বরকন্দাজ প্রাণ হারায়। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন