শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মদীনা সনদ

প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামের আর্বিভাব হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবকল্যাণ ও মানবতার জন্য। ইসলাম মানুষকে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়। নম্রতা একটি উত্তম গুণ, যা সচ্চরিত্রতার ফল। এ বিপরীতে কঠোরতা হচ্ছে ক্রোধের ফল। কঠোরতা কখনও ক্রোধ থেকে এবং কখনও তীব্র লালসা থেকে উৎপন্ন হয় কিন্তু নম্রতা সর্বাবস্থায় সচ্চরিত্রতারই ফল। সচ্চরিত্রতা তখনই অর্জিত হয়, যখন ক্রোধশক্তি ও খাহেশ শক্তিতে সমতার পর্যায়ে রাখা হয়। সে ব্যক্তি সহনশীল নয়, যে জুলুমের সময় চুপ থাকে, এরপর সক্ষম হলে প্রতিশোধ নেয়; বরং সহনশীল তাকে বলা হয়, যে জুলুমের সময় সহ্য করে এবং সক্ষম হলে মাফ করে। রাসূল (সা.) বলেন, হে আয়েশা, যে ব্যক্তি নম্রতার অংশ পেয়েছে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণের অংশ পেয়েছে। বলপ্রয়োগ অথবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিশ্বের কোথাও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আল্লাহতাআলা বলেন, ‘ফিতনা হত্যার চেয়েও ভয়াবহ’ (বাকারা-১৯১)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোন কোন কৃতকর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম-৪১)। ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফ্যাঁসাদ সৃষ্টি করো না’ (আরাফ-৫৬)। ইসলামে সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ফিতনাবাজ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কঠোর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। অমুসলিমদের প্রতিও কোন অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী (সা.)-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রজ্ব¡ল দৃষ্টান্ত। এক অমুসলিম বৃদ্ধার ঘটনা ইতিহাসে আমরা জেনেছি। যে বৃদ্ধা প্রতিদিন মহানবী (সা.)-এর চলার পথে কাঁটা দিত। একদিন রাসূল (সা.) দেখলেন, পথে কাঁটা নেই, তখন তিনি ভাবলেন, হয়তো ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়েছে বা কোন বিপদে আছে, তার খোঁজ নেয়া দরকার। এরপর দয়ার নবী (সা.) ওই বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দেখেন ঠিকই সে অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। এতে বৃদ্ধা অভিভূত হয়ে গেল যে, আমি যাকে কষ্ট দেয়ার জন্য পথে কাঁটা পুঁতে রাখতাম, সে-ই আজ আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে? ইনিই তো সত্যিকার অর্থে শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত। মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে লোকজন নিরাপদ থাকে, সেই মুসলমান এবং যার নির্যাতন থেকে মানুষ নিরাপদ; তাকে মুমিন বলে।’
নবী (সা.) নিজেকে তিনটি বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে বাঁচিয়ে রেখেছিলেনÑ ১. ঝগড়া-বিবাদ, ২. বেশি কথা বলা, ৩. অনর্থক বিষয়াদি হতে। অনুরূপ তিনটি বিষয় হইতে অন্যকেও বাঁচিয়ে রেখেছিলেনÑ ১. কারো নিন্দা করতেন না, ২. কাউকে লজ্জা দিতেন না, ৩. কারো দোষ তালাশ করতেন না।
রাসূলে কারীম (সা.)-এর ঘরে এক ইহুদি মেহমান হয়ে আসল। রাসূল (সা.) তাকে যথাযথ মেহমানদারী করলেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। ইহুদি মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে। রাসূল (সা.) তাকে কিছু বলবেন এই ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসূল (সা.) এ মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে, হায়! আমি ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি; হয়তো সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর মহামানব মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানা পরিষ্কার করলেন এবং ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন, ভাই আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে। আমি আপনার কোন যতœ করতে পারিনি। এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ! অতঃপর রাসূল (স.)-এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরূপ উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে।
মদিনা সনদ : মহানবী (স.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেন তা ইসলাম তথা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। মদীনায় বসবাসরত বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী, দল ও উপদলের সহাবস্থান, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাসূল (সা.) একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে ‘মদীনা সনদ’ নামে খ্যাত। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা রয়েছে। অতুলনীয় চরিত্র মাধুর্য, অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ, আমল ও আখলাক দ্বারা তিনি মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মদীনায় মুসলমান, ইহুদী এবং আওস ও খাযরায গোত্রসহ ১২টি উপগোত্রের বসবাস ছিল। চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে সকল গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করা যায় মহানবী (সা.) মদীনাকে তার একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী (সা.) ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। যেমন- সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। বহু ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মদীনার সনদ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মদীনার সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন সমাজের গোত্রসমূহের আন্তঃকলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশক’টি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুহাম্মদ (সা.) তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর সন্ধিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সাথে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.)কে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখ। এতে হযরত আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূল (সা.) নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন।
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (স.) বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী (সা.) বিজিত শত্রুদের প্রতি কোন ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, ‘আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। অতঃপর রাসূল (স.) বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।’ ইসলামে জাতি, শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্য নেই। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্রভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া বা পরহেজগারি। নারীদের বিষয়ে বিদায় হজের ভাষণে বলা হয়েছে ‘তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের উপর তাদেরও অধিকার রয়েছে’।
একজন বেদুঈন এসে মসজিদের ভেতরে পেশাব করতে লাগল। এতে উপস্থিত সাহাবীগণ তাকে ধমক দিলে রাসূল (সা.) বললেন, তাকে পেশাব করা থেকে বাধা প্রদান করো না। তাকে সুযোগ দাও; যাতে সে পেশাবের প্রয়োজন সেরে নিতে পারে, কারণ মধ্যখানে বন্ধ করলে ক্ষতি হবে। সে বেদুঈনের পেশাব করা শেষ হলে নবী কারীম (স.) তাকে ডেকে বললেন যে, এটা পেশাবের স্থান নয়; বরং এটা আমাদের ইবাদতখানা, পবিত্রস্থান। এ বলে তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন এবং এক সাহাবীকে পানি নিয়ে আসতে বললেন। অতঃপর মহানবী (সা.) নিজেই সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মসজিদ থেকে উক্ত পেশাব ধুয়ে দিলেন।” ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে নবী করীম (সা.) ও সাহাবাগণ কোন রকম জোর-জবরদস্তি করেননি। নায়েবে রাসূল (সা.), ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া, পীর-মাশায়েখ, অলি-আউলিয়া, হাক্কানী আলেম-ওলামা যুগ যুগ ধরে দুনিয়ার বুকে দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিরলসভাবে মেহনত করে চলছেন। যুগে যুগে যারা মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তারা অসাধারণ মানবপ্রেম, অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য, অতুলনীয় মানবিক মূল্যবোধ, দৃষ্টান্তমূলক সৎকর্ম, নিষ্ঠাপূর্ণ আমল ও পরিশুদ্ধ মননশীলতা দ্বারা বিশাল জনগোষ্ঠীকে ইসলাম গ্রহণে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার যে, রাসূল (স.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে জায়েজ নেই। সহিংসতা তো দূরের কথা অন্য ধর্মের প্রতি সামান্য কটূক্তিও না করার জন্য কুরআনে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে।” (আনআম-১০৮)। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস থেকে পরিত্রাণের জন্য পবিত্র কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা এবং নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস বিরোধী আয়াত ও ইসলামের মানবতাবাদী শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন