নেপাল সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসের দ্বিতীয় দিনই স্বর্ণপদকের দেখা পেলো বাংলাদেশ। দেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণ জিতলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রীড়াবিদ দিপু চাকমা। তিনি তায়কোয়ান্ডো ডিসিপ্লিনের পুমসে ইভেন্টে সোনা জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। প্রথমবারের মতো এসএ গেমসে খেলতে এসেই বাজিমাত করেন রাঙ্গামাটির এই ছেলে। সোমবার দুপুরে কাঠমান্ডুর সাদ্দোবাদোর ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস কমপ্লেক্সে পুরুষদের ২৯ প্লাস বয়স ক্যাটাগরিতে ৮ দশমিক ২৮ পয়েন্ট নিয়ে ভারত ও স্বাগতিক নেপালের প্রতিযোগিকে পেছনে ফেলে সোনা জিতেন দিপু। সঙ্গে সঙ্গে কমপ্লেক্সে বেজে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তায়কোয়ান্ডোর এই ইভেন্টে ছয়টি দেশ অংশ নিয়েছিল। পয়েন্ট পদ্ধতির ইভেন্টে দিপু সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়ে সোনা জয় করেন। ভারত ও নেপালের প্রতিযোগি যথাক্রমে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক পান।
এরআগে দেশ-বিদেশে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাঁচটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্যপদক জিতলেও এটা দিপুর প্রথম কোন আন্তর্জাতিক গেমসে খেলা। আর প্রথম আসরেই আলো ছড়ালেন ৩১ বছর বয়সী এই ক্রীড়াবিদ। তাও আবার এসএ গেমসে প্রথমবারের মতো যুক্ত হওয়া পুমসে ইভেন্টে স্বর্ণ জেতার সাফল্য। যে সাফল্যে তিনি নিজের নামটা নিয়ে গেলেন অনন্য এক উচ্চতায়। গেমসে খেলতে নেপাল আসার আগেই তায়কোয়ান্ডো ডিসিপ্লিন থেকে দু’টি স্বর্ণের আশা করেছিলেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম রানা। যার প্রথমটি ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে বাংলাদেশ।
সোনা জয়ের পর আনন্দে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন দিপু। সাফল্য পেয়ে জাতীয় পতাকা বুকে জড়িয়ে দৌড়ে আসেন কোচ ও কর্মকর্তাদের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঠমান্ডুতে গেমস কাভার করতে আসা বাংলাদেশী সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেন দিপুকে। দেশকে প্রথম সোনা এনে দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় এই স্বর্ণজয়ী বলেন, ‘আমি এখনো ঘোরের মধ্যে আছি। দেশের বাইরে খেলতে এসেছি, দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছি। দেশকে কিছু দিতে পেরে আমি গর্বিত। আন্তর্জাতিক আসরে দেশের পক্ষে প্রথম সোনা জয়ের আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা অন্যরকম এক অনুভূতি। আমার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি স্বর্ণপদক জয় করে ফেলেছি। তবে এটা বলতে পারি সাফল্য পেয়ে অনেক অনেক ভালো লাগছে।’
২০০১ সাল থেকে তায়কোয়ান্ডোতে খেললেও এই ডিসিপ্লিনে দিপু নিয়মিত হয়েছেন ২০০৮ সাল থেকে। বড় ভাইকে দেখে তায়কোয়ান্ডোতে নাম লেখান দিপু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ আমার বড় ভাইয়ের আত্মত্যাগের মাধ্যমে তায়কোয়োন্ডাতে আসা। বড় ভাই ফরম নিয়ে গিয়েছিলেন তায়কোয়ান্ডো শিখবেন বলে। কিন্তু পরীক্ষার কারণে তিনি ফরম পূরণ করতে পারেননি। তাই উনার পরিবর্তে আমিই ভর্তি হয়েছিলাম তায়কোয়ান্ডোতে। ২০০১ সালে রাঙামাটিতে তায়কোয়ান্ডোর উপর একটি ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে রানা স্যারও (ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক) ছিলেন। আমার খেলা দেখে তিনি পজিটিভ মার্ক দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য আমি ভর্তি হই এখানে।’ দিপু আরো বলেন,‘ মাঝে আমি তায়কোয়ান্ডো থেকে অনেক দূরে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে চাকরিও হয় আমার। সবকিছু ভুলে যাই। তবে ২০০৬ সালে কলম্বো এসএ গেমসে তায়কোয়ান্ডো থেকে বাংলাদেশকে স্বর্ণপদক এনে দেন মিজানুর রহমান স্যার। কলম্বোর মাটিতে জাতীয় সঙ্গীত বেজেছিল। লাল- সবুজের পতাকা উড়েছিল। ওই দৃশ্য দেখে আমি আবিভূত হয়ে পড়ি। দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। তাই ২০০৬ সালেই ফের তায়কোয়ান্ডোতে ফিরে আসি।’ তিনি যোগ করেন,‘২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এসএ গেমস। ক্যাম্পে থাকলেও ঘরের মাঠে খেলতে পারিনি জাতীয় দলে না থাকার কারণে। ২০১৬ গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসের আগেও ছিলাম জাতীয় দলের ক্যাম্পে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে পুমসেতে অনুশীলন শুরু করলেও গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসে এই ইভেন্টটি ছিল না। তাই আমার খেলা হয়নি ওই আসরে। তবে সোনা জয়ের জন্য পাখির চোখ করেছিলাম নেপালের এসএ গেমসেই।’
প্রথমবারের মতো আর্ন্তজাতিক আসরে খেলতে আসার আগেই লক্ষ্যটা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন দিপু চাকমা। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ভালো কিছু করার। নিজ মুখেই শোনালেন তা, ‘এর আগে কোনো অফিসিয়াল গেমসে কখনও সোনার পদক পাইনি। অন্যান্য দেশে খেলতে গিয়ে স্বর্ণপদক জিতেছি। কাঠমান্ডুতে স্বর্ণ জয় করতে পেরে অনেক গর্ববোধ করছি। আসলে আমরা গোল্ড মেডেলের লক্ষ্য নিয়েই এখানে এসেছি। প্রস্তুতিও সেরকম ছিল। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় অনেক ভালো লাগছে।’ এর আগে ২০১৬ সালে এই নেপালেই এশিয়ান হামবাদান গেমসে (আমন্ত্রনমূলক) সোনা জিতেছিলেন দিপু। আর কাল সেই নেপালেই জিতলেন ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক। তার এই সাফল্যের মূল কারিগর হিসেবে দলের প্রধান কোচ কোরিয়ান মিন হাক সেও’কে দিলেন পুরো কৃতিত্ব, ‘কোরিয়ান কোচ দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র একমাস আগে। কিন্তু গত একমাসেই আমাদের অনেক উন্নতি করিয়েছেন। তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
দিপুর স্বর্ণ জয়ে দারুণ খুশি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা। গেমস ভেন্যুতে উপস্থিত থেকে দিপুকে উৎসাহ যোগানোর পাশাপাশি প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে পদকজয়ীদের গলায় পড়িয়ে দেন মেডল। সৈয়দ শাহেদ রেজা বলেন, ‘আমাদের সোনার পদক জেতা শুরু হলো। এটা আশা করি অব্যাহত থাকবে। আমি কিন্তু গেমসের আগে একদিনও বলিনি আমরা কোন ইভেন্টে কয়টা স্বর্ণ পাবো। কারন আমার লক্ষ্য গত আসরের চেয়ে বেশী পদক জয় করা। তাছাড়া আমি নির্দৃষ্ট করে কোন ইভেন্টের নাম বললে অন্য ইভেন্টের অ্যাথলেটরা মন খারাপ করবে। আমার কাছে সবাই সমান।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন