রাজধানীতে দিন দিন বেড়েই চলছে মশার উৎপাত। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মশা। রাতে তো বটেই দিনের বেলায়ও চলছে মশার এমন অত্যাচার। মশারি টানিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে, ইলেকট্রিক ব্যাট কিংবা মশানাশক ওষুধ স্প্রে করেও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ মশা নিধনে বছর বছর বরাদ্দ বাড়াচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এ খাতে চলতি অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মোট বরাদ্দ ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা আর দক্ষিণ সিটির বরাদ্দ ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। দুই সিটির মশা নিধনে এতো টাকা বরাদ্দ থাকার পরও রাজধানীর মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। অনেকেই অভিযোগ করে বলছেন, বরাদ্দ বাড়লেও মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলছে না। তাদের মতে, বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশার উপদ্রব। তাহলে মশা নিধনে বরাদ্দের টাকা যাচ্ছে কোথায়?
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পুকুর-ডোবা, নালা-নর্দমার কচুরিপানা ও ময়লা পরিষ্কার না করায় সেগুলো মশা উৎপাদনের খামার হিসেবে কাজ করছে। মশা নিধনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তবে অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ স্প্রে করার জন্য প্রতি ওয়ার্ডে ৬ জন করে কর্মী থাকলেও কয়েক মাসেও তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেজগাঁও, মহাখালী, ফকিরাপুল, কমলাপুর, মানিকনগর, বাসাবো, মুগদা, খিলগাঁও, ধোলাইখাল, মীর হাজীরবাগ, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর, সূত্রাপুর, মোহাম্মদপুর, সায়েদাবাদ, রামপুরা, বাড্ডা, কুড়িল, মিরপুর, গাবতলী, দারুস সালাম, হাজারীবাগ, গোড়ান এলাকায় মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও নগরীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডিতেও বেড়েছে মশার উপদ্রব। অভিজাত এলাকাগুলোর বেশির ভাগ ফ্ল্যাট বাড়িতে দরজা-জানালায় নেট লাগানো সত্তে¡ও যেন রেহাই নেই মশার অত্যাচার থেকে। নিচতলা থেকে শুরু করে ২০ তলা পর্যন্ত সর্বত্রই মশার সমান উপদ্রব।
বিশেষজ্ঞরা মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে না আসার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে তারা দেখছেন সিটি কর্পোরেশনের লোক দেখানো বিভিন্ন কার্যক্রমকে। এছাড়া রাজধানীর জলাশয়গুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা এবং সেখানে সিটি কর্পোরেশন ঘোষিত কোনো ধরনের অভিযান না চালানোয় মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে বিশ্লেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাশাপাশি শীতকালের কয়েক মাসে মশা নিধন কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাওয়ার করণে মশার উপদ্রব বেড়েছে বলে মত তাদের।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনেও মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। রাত নামতে তা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। মশাবাহিত রোগের আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাদের তাড়া করছে। পরীবাগ এলাকার বাসিন্দা মামুনা আক্তার বলেন, গত বছর চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। এ বছরও মশার উৎপাত অনেক বেশি। এবার যদি আবার মশাবাহিত রোগ হয় তাহলে বাঁচার উপায় থাকবে না।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ রাখা হয় মশা নিধনের জন্য। বরাদ্দকৃত টাকা খরচও করে দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু নগরীতে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না তেমন একটা।
অভিযোগ রয়েছে, মশার ওষুধ ছিটানো হয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের পছন্দের এলাকায়। কোথাও কোথাও ছয় মাসেও একবার দেখা যায় না আবার কোথাও মাসে দুই থেকে তিনবারও ওষুধ ছিটানো হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শরীফ আহম্মেদ বলেন, মশা নিধন কর্মীরা নিয়মিত কাজ করছে। কোথায় কোথায় ওষুধ ছিটাতে হবে সেটা দেখভাল করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে একটি কমিটির সদস্যরা। তারাই ভালো জানে কোন এলাকায় বেশি সমস্যা। যদি কোনো এলাকায় ওষুধ ছিটানো না হয় তাহলে কাউন্সিলরদের জানালে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
রাজধানীতে এখন মশার যন্ত্রণা বেড়েছে কয়েকগুন। নিম্ন মানের কয়েল, মশারি, মশা মারার বৈদ্যুতিক ব্যাটও মশার হাত থেকে রেহাই দিতে পারছে না রাজধানীবাসীকে। যথাসময়ে জলাশয়, আবর্জনা পরিষ্কার-পরিছন্ন না করা, ও মশা নিধন কার্যক্রম শুরু না করার কারণেই মশার বিস্তার ঘটেছে। মশার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছে সবাই আর এরই সাথে বাড়ছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়াসহ নানাবিধী মশাবাহি রোগ জীবাণু। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মশা নিধন কার্যক্রম চলছে। তবে তা দৃশ্যত নেই বলেই জানান ভুক্তভোগীরা।
মোস্তফা কামাল নামে হাজারীবাগের এক বাসিন্দা বলেন, শীতের মৌসুমের শুরু থেকে নগরীতে মশার দাপট বেড়ে গেছে। দিন-রাত সব সময়ে মশা থাকে। রাতে মশার কয়েল ও ওষুধ স্প্রে করেও রেহাই পাওয়া যায় না। রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমালেও দিনে বিশ্রাম নিতে লাগাতে হয় মশারি। তিনি বলেন, মশার উপদ্রব বাড়ার কারণ হিসেবে নিয়মমাফিক ওষুধ ছিটানো না হওয়া এবং অনেক এলাকায় ঝিল, নালা-নর্দমা ও অন্যান্য জলাশয় পরিষ্কার না করায় এসব মশার প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে গেছে। এছাড়া মশার ওষুধ ছিটাতে তিন মাসেও কোনো কর্মীকে দেখা যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বলেন, শীতের সময়ে মশার উপদ্রব একটু বেশি হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তখন বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি হলে মশার প্রজনন স্থানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ভাসমান পানিতে মশা জন্মাতে পারে না। আবদ্ধ পানি কিংবা শুকনা স্থানে মশার প্রজনন বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৮ নং ওয়ার্ড ছাড়া প্রথম ১৩টিতে ৩১২ একর জলাধার রয়েছে। এগুলো কচুরিপানা ও আবর্জনায় ভর্তি। একই চিত্র ১৪, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ওয়ার্ডের ৩২ একর জলাধারের। এছাড়াও ৭, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪৪ বিঘা ৯ কাঠা জলাশয় দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জলাশয় রয়েছে প্রায় এক হাজার বিঘা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে রয়েছে ৪৮৭ বিঘা। এসব জলাশয়ে কচুরিপনা ও আবর্জনা জমে আছে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফলে শীত মৌসুম এলে জলাশয়ের আবদ্ধ পানি দুর্গন্ধময় হয়ে মশার প্রধান প্রজনন স্থলে পরিণত হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবাহান বলেন, মশার উৎপত্তিস্থলে অভিযান না চালিয়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন বিভিন্ন ধরনের লোক দেখানো কর্মসূচি নিয়ে। এসব করে মশা নিধন সম্ভব নয়। অথচ এখনো মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন ডোবা, জলাশয়ে মশা মারার অভিযান ওইভাবে চালায়নি। শুধু লোক দেখানোর জন্য সড়কের আশপাশে মশা মারার অভিযান চালাচ্ছে।
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআরবি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নুজহাত নাসরিন বলেন, আগে জলাশয়গুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করতে হবে। কারণ মশার বংশবৃদ্ধি হয় সেখান থেকে। যেহেতু তারা দাবি করছে- মশা নির্মূলে তারা সব করছেন, সেহেতু তাদের উচিত নিজেদের দুর্বলতার জায়গা খুঁজে দেখা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মশা নিধনে দুই সিটি কর্পোরেশন একই ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বর্তমানে মশা নিধনের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রামকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে লার্বিসাইড ওষুধ ছেটানো হচ্ছে। মশা নির্মূলে স¤প্রতি দুই সিটি কর্পোরেশন তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কার্যক্রম উদ্বোধন করছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীবাসীকে যতদ্রুত সম্ভব মশার উৎপাত থেকে মুক্ত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চলছে। তারা দু’জনেই আশাবাদী মশার উৎপাত দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, শহরের প্রায় অর্ধেকের বেশি স্থানে মশার ওষুধ ছেটানো সম্ভব হয় না। মশা নিধনে দুর্বলতার বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, অধিকাংশ জলাশয় রাজউকের। এরপর সরকারি অনেক স্থানে সিটি কর্পোরেশন যেতে পারে না। এছাড়া বাসা-বাড়ির ভেতরে মশার ওষুধ ছেটানো সম্ভব হয় না। একই সমস্যার কথা জানিয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বলেন, অনেক এলাকায় আমরা মশার ওষুধ ছিটাতে পারি না। এছাড়া ওয়াসার খালে পানি প্রবাহ না থাকায় মশার বংশ বিস্তার সেখানে হয়। তবে নতুন করে কিছু পদক্ষেপ নেব। আশা করি, সমাধান আসবে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকাবাসীরা সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে মশা। দিনের বেলায় উপদ্রব কিছুটা কম থাকলেও রাতের বেলায় অসহনীয় হয়ে উঠে। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল থেকে শুরু করে চলন্ত গাড়িতেও মশা উপদ্রব বেড়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধনের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য ৫ থেকে ৬ জন করে কর্মী নিযুক্ত আছেন। তারা দিনে দুবার ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। তবে সিটি কর্পোরেশন এমন দাবি করলেও নগরবাসী তাদের দেখতে পান কালেভদ্রে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন