সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ঐতিহ্যের গতিধারায় আজকের মাদ্রাসা শিক্ষা

প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
যুগে যুগে আলেম সমাজের জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। আলেমরা সারাটা জীবন জ্ঞানের চর্চায় কাটিয়ে দেয়ার পর অনেকের জীবনে এখনো বঞ্চনা। ইসলাম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আমরা অনেকে গর্ব করি। যে ইতিহাস না থাকলে মানব জাতির অতীতকাল অন্ধকারে ছেয়ে থাকত, তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে আলেম সমাজ। যুগে যুগে আলেমদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদান না হলে ইতিহাস বলে লিখিত কোন প্রামাণ্য পুস্তক থাকত না, গ্রীক দর্শন আরবিতে তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ হত না, পাশ্চাত্যে জাগরণ আসত না। স্বয়ং ইসলামী সমাজেও কোরআন-হাদিসের চর্চায় আলেমগণ জীবন উৎসর্গ না করলে ইসলাম ও ইসলামী জ্ঞানের কিছুই অবশিষ্ট থাকত না।
উপমহাদেশে প্রায় ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনামলে যে শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল তা ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা। ইংরেজি শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষা তো আসে অনেক পরে ব্রিটিশ শাসন আমলে। ওই সময়ে স্বয়ং গির্জা শাসিত ইউরোপও ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানে অজ্ঞতার অন্ধকারে। মাদ্রাসা শিক্ষার আলোতেই ভারতবর্ষ শিল্প ও স্থাপত্যে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছিল, যার কালজয়ী প্রমাণ বিশ্বের সপ্তার্যের অন্যতম বিস্ময় তাজমহল। হেকেমি চিকিৎসার ঐশ্বর্যের ধারাবাহিকতা তো এখনো বহন করছে হামদর্দ ও আয়ুর্বেদিক। হাদিস শাস্ত্রের চর্চা যখন সারা দুনিয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন ভারতবর্ষে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রা) হাদিস শাস্ত্র চর্চায় পুনরুজ্জীবন দান করেন, যার আলোতে দুনিয়া এখনো আলোকিত। অর্থনৈতিকভাবেও বিশ্বের এ অঞ্চলটি এতখানি সমৃদ্ধ ছিল যে, ইউরোপীয় বণিকরা সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে বাণিজ্যের লোভে এখানে এসেছিল এবং সুযোগ বুঝে বাংলার মসনদ দখল করে দীর্ঘ দুইশ বছর আমাদেরকে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ রেখেছিল। ইতিহাসের এই বাস্তবতাগুলো সামনে আনলে কোন হিংসুকও বলতে পারবে না যে, তখনকার দিনের মুসলিম শাসন কোন দিক থেকে পশ্চাৎপদ ছিল কিংবা তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তি মাদ্রাসা শিক্ষায় কোন দিক থেকে অপূর্ণতা ছিল।
ইংরেজ আসার পর ক্ষমতাহারা আলেমদের হাত থেকে ওয়াকফ ও লাখারজ সম্পত্তির রাষ্ট্রীয় বরাদ্দগুলো কেড়ে নেয়া হয়। কালক্রমে মুসলমানরা দুবেলা খাবার জুটানোর জন্য সকাল-সন্ধ্যা প্রাণান্ত সংগ্রাম চালাতে বাধ্য হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই বলেছেন যে, আগের দিনে মুসলমানদের মধ্যে গরিব ও অশিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। অথচ ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় চরমভাবে পিছিয়ে যায় আর অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়েছিল নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুসলমানদের দেউলিয়াত্ব। এই পরিস্থিতিতেই মুসলিম সমাজের সচেতন লোকেরা বিচলিত হয়ে অন্তত দ্বীনধর্ম রক্ষার তাগিদে মোল্লা মজদুদ্দীন নামক একজন বিজ্ঞ আলেমকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের শাসনকেন্দ্র বা রাজধানী কলকাতায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাদের চেষ্টা সফল হলে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা মাদ্রাসা। ইংরেজরা এই শর্তে কলকাতা মাদ্রাসার অনুমতি দেয় যে, এর প্রধান হিসেবে থাকবে কোন ইংরেজ আর শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন একজন আলেম এবং তার পদবি হবে হেড মওলানা। সেই শর্ত অনুযায়ী ১৯২৬ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার প্রিন্সিপালের পদ ইংরেজদের হাতে ছিল। ১৯৪৭ সালে পাক ভারতের স্বাধীনতার সময় মাদ্রাসা আলিয়া ও তার সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ভাগ হয়ে অর্ধেক চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, বর্তমান বকশিবাজারে। মাদ্রাসা আলিয়া ঢাকার সর্বশেষ হেড মওলানা ছিলেন বায়তুল মোকাররমের খতিব মরহুম হযরত মওলানা উবায়দুল হক। তারপরে সেই পদবিটি ভাইস প্রেন্সিপাল হিসেবে পরিবর্তন করা হয়।
উল্লেখ্য যে, ইংরেজদের হাতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ডুবেছিল ১৭৫৭ সালে আর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮১ সালে। আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি না জানার কারণে কিংবা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষী মন নিয়ে একশ্রেণীর জ্ঞানপাপী বলতে চান যে, ব্রিটিশ সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ধরুন, কোন ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলে কেউ যদি ইসলামের প্রচার-প্রসারের উদ্দেশে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে চায় তাহলে অবশ্যই সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে কেউ কি এই বিভ্রান্তি ছড়াতে পারবে যে, ইসলামবিরোধী সরকার ষড়যন্ত্র করে পত্রিকাটি চালু করেছে।
বস্তুত এই অবস্থা অব্যাহত গতিতে চলছিল এবং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অনেক শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল এই অঞ্চলে। এরই মধ্যে ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা পোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এটি ছিল বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ও হিন্দু সংস্কৃতি চালুর সূতিকাগার। রাজ্যহারা মুসলমানারা তখন ইংরেজদের শত্রু জ্ঞান করত এবং ইংরেজি শিক্ষা হারাম ঘোষণা করেছিল।
এর ধারাবাহিকতায় জিহাদের অগ্নিবীণা বেজে উঠেছিল বালাকোটের ময়দানে ১৮৩০ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদ (র)-এর নেতৃত্বে। আলেমদের এই সশস্ত্র জিহাদ আপাতত ব্যর্থ হলেও জিহাদের পয়গাম ধুমায়িত হয় উপমহাদেশের আনাচে-কানাচে। যার প্রবল শ্রোতে সমগ্র ভারতজুড়ে সংঘটিত হয় সিপাহি বিপ্লব। স্বাধীনতা হারানোর ঠিক একশ বছর পর ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহি বিপ্লবে যোগ দিয়েছিল ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর মুসলিম সিপাহিরা এবং তাদের সঙ্গে হিন্দু সৈনিকরা। কিন্তু নানা কারণে সে বিপ্লবও ব্যর্থ হয় এবং বিপ্লবী মুসলমানদেরকে বিভিন্ন স্থানে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে দমন করা হয়। যার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও সেখানে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ।
তখন আরো একবার অমানিশার ঘনঘটা দেখা দেয় ভারতীয় মুসলমানদের জীবনে। একের পর এক সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয়ের পর জাতিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার উদ্দেশে বালাকোটের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আলেমগণ ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। শুরু হয় ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুন পুনরুজ্জীবনের নতুন রেনেসাঁ। শুরু থেকেই ইংরেজ সরকার পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসা ও দেওবন্দ মাদ্রাসার মধ্যে কোন বিদ্বেষ বা রেষারেষি ছিল না। যার সাম্প্রতিকতম জ্বলন্ত প্রমাণ মরহুম মওলানা উবায়দুল হকসহ দেওবন্দ মাদ্রাসা হতে ফারেগ অনেক বিদগ্ধ আলেম জীবনভর আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও খেদমত করে গেছেন। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠায় যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি অর্থাৎ মওলানা আব্দুল আজিজও ছিলেন মাদ্রাসা আলিয়ার ছাত্র।
আলেম সমাজ ও মুসলমানদের ওপর ইংরেজদের যখন চরম দমন ও দলন নীতি চলছিল তখন সেই সুযোগে হিন্দুরা ইংরেজদের অধীনে শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি চাকরি-বাকরি লুফে নিতে থাকে। তখন স্যার সৈয়দ আহমদের মত দূরদর্শী মুসলিম নেতারা বুঝতে পারেন যে, পরিস্থিতির বাস্তবতা বলতে একটি জিনিস আছে। মুসলমানরা এই বাস্তবতাকে বুঝতে না পারলে অচিরেই আরো চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। তারই প্রচেষ্টায় ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আলীগড় মুসলিম স্কুল এবং পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আলেম সমাজের মনেও সংস্কারবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়। তারা জোরালোভাবে বললেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় করতে হবে। সিলেটের মওলানা আবু নসর ওয়াহীদের নেতৃত্বে আলিয়া মাদ্রাসাকে তখন পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে দুইভাবে বিন্যস্ত করা হয়। একটির নাম ওল্ড স্কীম, অপরটির নাম নিউ স্কীম। নিউ স্কীমে জেনারেল স্কুল-কলেজের বইপুস্তক এবং পাশাপাশি মাদ্রাসার কিতাবাদি পড়ানো হত। বর্তমান আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর দিকে তাকালে তখনকার নিউ স্কীমের কথা সহজেই অনুমান করা যায়। তখন বলা হয় যে, মাদ্রাসার উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের জন্য আরবি বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
১৯৪৭ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে তখন নিউ স্কীম মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১০৭৪টি। তবে এগুলো নামে মাদ্রাসা থাকলেও ভেতরটা স্কুল-কলেজে পরিণত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকার এক আদেশ বলে সকল জুনিয়র নিউ স্কীম মাদ্রাসাকে হাই স্কুল এবং সিনিয়রগুলোকে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে রূপান্তরিত করে দেয়। নমুনা হিসেবে বলা যায়, বর্তমান চট্টগ্রাম মহসিন কলেজ আগে ছিল মোহসেনিয়া মাদ্রাসা, ঢাকার নজরুল কলেজ ও হাম্মাদিয়া হাইস্কুল দুটি ছিল হাই মাদ্রাসা, মাদ্রাসার আকৃতি পাল্টে ভোলার আব্দুর রব হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে সংক্ষুব্ধ আলেমদের সান্ত¡নার জন্য সাবেক মন্ত্রী মুশাররফ হোসেন শাহজাহানের বাবার দেয়া জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান ভোলা আলিয়া মাদ্রাসা। রাজশাহী হাই মাদ্রাসা এখনো স্বনামে থাকলেও ভিতরে চলছে স্কুল। বর্ধিত বেতন ভাতার লোভের কবলে পড়ে কলকাতা আলিয়া, সিলেট আলিয়া ও শর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া বাকি সব মাদ্রাসা তখন নিউ স্কীমের টোপ গিলে আত্মহত্যা করেছিল। পরবর্তীতে এই তিন মাদ্রাসা থেকে শাখ-প্রশাখা বের হয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর আকাশে আবারো নিউ স্কীমের অমানিশা দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে দেওবন্দের সিলেবাসের আদলে গড়ে ওঠা কওমী মাদ্রাসাগুলোর সামনেও নিউ স্কীমের হাতছানি এসেছে। এখন কওমী মাদ্রাসার মুরব্বীদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি ইতিহাসকে সামনে রেখে নিজেদের অতীত ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখে দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পথ চলবেন? নাকি আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর ন্যায় বারবার আত্মহত্যার অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন। কথাটি অনেকের কাছে কঠিন মনে হতে পারে। এজন্যে একান্ত অনিচ্ছায় লিখছি যে, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আমার লেখালেখির বয়স অন্তত তিন যুগ। দেশের পত্রপত্রিকায় মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে আমার যতগুলো প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যদি সেগুলো এক পাল্লায় রাখা হয় আর অন্যদের লেখা একত্রে এক পাল্লায় রাখা হয় তাহলে আল্লাহ চাহেন তো, আমার লেখাগুলোর পাল্লা ভারি হবে। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার পতাকায় আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে অন্য অনেকের সাথে আমার ভূমিকার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই না। কাজেই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হতে মনের দুঃখে কথাগুলো বলতে হল।
আমার ক্ষুদ্র অভিমত হচ্ছে, আধুনিক জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া ও চর্চার জন্য এটা শর্ত নয় যে, ছোটবেলা থেকেই বিদেশি ভাষা শিখাতে হবে এবং বিরাট বিরাট বইয়ের বোঝা শিশুকিশোরদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে হবে। বরং তাতে ফল হয় উল্টা। কোমলমতি ছেলেমেয়েরা এতবেশি বোঝা বহন করতে পারে না। তাছাড়া আজকের ইংলিশ স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজের অতীত ও ঐতিহ্যের প্রতি উদাসীন হয়ে ফার্মের মুরগি হয়ে গড়ে উঠার মূল কারণ হচ্ছে, শৈশব থেকে ইংরেজিতে তাদের মুখের বুলি ফোটানোর কসরত। মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায়ও কথাটি সত্য। হুযুরদের মধ্যে যাদের মনে উর্দু ও ফারসির মায়া বেশি তারা নিচের ক্লাসগুলোতে ছেলেমেয়েদের এসব ভাষা শেখানোর অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত চেষ্টা চালান। তাদের প্রতি পরামর্শ হল, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করুন এবং উর্দু, ফারসি, ইংরেজি বা অন্য যে কোন ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করুন উচ্চতর ক্লাসে বা একদম শেষে।
অনুরূপভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার মূল বিষয়গুলোর ওপর শুরু থেকে গুরুত্ব দিয়ে অন্য বিষয়সমূহ উচ্চতর স্তরে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করতে হবে, মাদ্রাসার পরিভাষায় যাকে ফুনুনাত বলা হয়। পরিশেষে একটি তথ্য দিয়ে আজকের আলোচনার ইতি টানতে চাই। ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়েছে আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৭৯ সালে। শিয়া আলেমরাই সেখানে এখনো ক্ষমতার দ-মু-ের মালিক। ইরানের হাওযেয়ে এলমিয়ে বা মাদ্রাসাগুলো এখনো বেসরকারি। এসব মাদ্রাসার যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন আয়াতুল্লারা। এগুলোকে স্কুল-কলেজের সাথে একাকার করতে হবে বা জেনারেল এডুকেশন ঢুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মানের সার্টিফিকেট দিতে হবে এমন কথা সেখানে অবান্তর।
আমাদের দেশে যারা আধুনিক শিক্ষা ও দ্বীনি শিক্ষার সমন্বয় চান তারা আলিয়া নেসাবের মাদ্রাগুলোতে এসে লেখাপড়া করতে পারে। যারা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায় তারা জেনারেল লাইনে চলে যাবে। এগুলোও তো আমাদের প্রতিষ্ঠান। এগুলোকে পর ভাবার চিন্তা নিশ্চয়ই ভুল এবং এই ভুল সংশোধন করতে না পারলে গোটা জাতিকে আপন করা ও তাদেরকে ইসলামের সাহায্যকারী হিসেবে পাওয়ার প্রত্যাশা হবে আকাশ কুসুম কল্পনা। যারা দ্বীনের দায়ী ও শরীয়া আইনে বিশেষজ্ঞ হবেন তাদের জন্যই তো মাদ্রাসা শিক্ষা। প্রয়োজনে মাদ্রাসার সংখ্যা কম হোক, তাতে আপত্তি নেই। এদেশে খ্রিস্টানদেরও অনেক সেমিনারি আছে, এগুলো তাদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব অভিজ্ঞতা কাজে না লাগিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি হবে মারাত্মক।
‘ইন উরীদু ইল্লাল ইসলাহা মাস্তাতা‘তু ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনীব’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন