শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান স্মরণে

প্রকাশের সময় : ২৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী
১৯ রমজান (২৫ জুন) শনিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায় ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক কবি মাওলানা রুহুল আমীন খান সাহেবের টেলিফোন ‘মাওলানা ... ইন্তেকাল করেছেন। খবর কি শুনছেন? নামটি প্রথমে সঠিকভাবে বুঝতে না পারায় জিজ্ঞাসা করলাম কোন মাওলানা বললেন; আপনার দীর্ঘকালের বন্ধু মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। বললাম, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে খবর পেয়েছেন, বিস্তারিত সংবাদ কী? বললেন, ‘ছারছিনার পীর সাহেব খবরটি জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এর বেশি কিছু জানতে পারিনি। মাওলানা রুহুল আমীন খান শোক বাণী লেখার কথা বলে ফোন ছেড়ে দিলেন। আমি বিস্তারিত খবর জানার জন্য টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেল দেখতে থাকি, কিন্তু তাৎক্ষণিক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের কোনো খবর চোখে পড়ল না। হঠাৎ আমার মেয়ে মালিহা তার বাসা থেকে মোবাইল করায় প্রথমেই জানতে চাইলাম, ইন্টারনেটে এ সম্পর্কে কিছু এসেছে কিনা? সে অনলাইনের ২৪ পত্রিকার পূর্ণ খবরটি পড়ে শুনালো। এভাবে খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম। কিছু দিন ধরে মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের শারীরিক অসুস্থতার খবরাখবর দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়ে আসছিল। এত দ্রুত তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে যাবেন, এ বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু নির্ধারিত সময় এলে সবাইকেই চলে যেতে হবে, আল্লাহর এ বিধানকেও বিশ্বাস করতে হবে। হাদিসের ভাষ্য : ‘মওতুল আলেমে’ ‘মওতুল আলামে’ একজন আলেমের মৃত্যু যেন একটি জাহানের মৃত্যু। বস্তুত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন একজন আলেম। বাংলা দেশের আলেম সমাজের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন একজন শীর্ষ স্থানীয় মুরব্বি শ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ, উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ইসলামের নানা ক্ষেত্রে যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর এবং গবেষণার বিষয়বস্তু। ইসলামের এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনকালকে কম বলা না গেলেও তার কর্মক্ষেত্রের বিশালতা এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, যা তার সমসাময়িক আলেমগণের মধ্যে খুব বেশি দেখা যাবে না। তিনি আজীবন কলম ও জবান যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন ইসলাম, মুসলমান এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে, মুসলিম উম্মাহর মঙ্গল কল্যাণে। এক্ষেত্রে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিরও অধিকারী ছিলেন। বাংলায় মুসলিম সাংবাদিকতায় তার মাসিক মদীনা ও সপ্তাহিক মুসলিম জাহান, কেবল এদেশের আলেম সমাজ নয়, বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক সমাজকেও কম প্রভাবিত করেনি। ইসলামের অসংখ্য শাখায় তার রচনা সমাহার এবং অনুবাদ ভা-ার ইসলামী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ, অথচ তিনি ছিলেন নিছক মাদ্রাসা পড়–য়া ছাত্র, স্কুল-কলেজের আঙ্গিনায় তার পদচারণা ছিল না। তার রচনাবলির সংখ্যা অনেক দিন আগেই শতাধিক ছাড়িয়ে যায়।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১৯ এপ্রিল মোতাবেক বাংলা ১৩৪১ সালের ৭ বৈশাখ, গফরগাঁও জেলার শাখচূড়া গ্রামে। তার শিক্ষা জীবন, গফরগাঁও আলিয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে আলিম পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল, কামিল (টাইটেল) বিভাগে হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রদ্বয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। সম্ভবত এটি ১৯৫৬ সালের কথা।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বংশগত দিক থেকেও ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত বংশের কৃতী সন্তান। তার পিতার নাম হাকীম মাওলানা আনসার উদ্দীন খান। এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি দুবার কারাবরণ করেন। তিনি একজন আলেমে দ্বীন হওয়ার পাশাপাশি একজন রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক এবং সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সুযোগ্য পুত্র মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তার বংশ ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হওয়া ছাড়াও পিতার মিশনকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যান সফলভাবে।
মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তার পূর্বসূরি মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও মাওলানা ইসলামাবাদী প্রমুখের সাংবাদিকতা ও লেখনী আদর্শের অনুসরণ করে শিক্ষা জীবন শেষ করেই বাংলা সাংবাদিকতার জগতে প্রদর্শন করেন। তিনি সাপ্তাহিক ‘আজ’ ও ‘নয়া জামানা’ তদানীন্তন ইসলামিক একাডেমির মাসিক মুখপাত্র ‘দিশারী’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন ছাড়াও ১৯৬১ সালের মার্চ থেকে নিজ সম্পাদনা ও মালিকনায় মাসিক মদীনা প্রকাশনা শুরু করেন। বিগত ৫৫ বছর ধরে পত্রিকাটি প্রায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে, যার বিপুল সংখ্যক পাঠক বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের আসামে পশ্চিম বঙ্গের নানা স্থানে এবং মুসলিম বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বহু পাঠকই প্রচার সংখ্যা লক্ষাধিক বলেন। তার প্রকাশিত সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান নামক পত্রিকার বয়সও সিকি শতাব্দীর বেশী।
মরহুম মাওলানা খানের মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে রচনাবলির সংখ্যা শতাধিক বলে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সীরাত জীবনী কোরআনের তফসীর, বাণী সংকলন, ইসলামী আন্দোলন, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি প্রভৃতি নানা বিষয়ের ওপর তার অনুবাদ ও রচনাবলি বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। হযরত মাওলানা মুফতি শফী (র.) রচিত ৮ খ-ে ‘মা’রেফুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ তার রচনাবলির বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ সউদী আরব সরকার প্রকাশ করেছে, যা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তার অপূর্ব লেখনী শক্তি ছিল আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি যে কোনো বিষয়ের দ্রুত অনর্গল লিখতে পারতেন । তার বিক্ষিপ্ত রচনাবলি, ভূমিকা, বিবৃতি ইত্যাদির সংখ্যা বিপুল।
একজন সুদক্ষ এবং অভিজ্ঞ প্রকাশক হিসেবে মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন আদর্শ। তিনি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে আলতু ফালতু বইপুস্তক প্রকাশ করে বহু অর্থ উপার্জন করতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। তার প্রকাশনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইসলামী আদর্শভিত্তিক নানা বিষয় ছাড়া ও ইসলামী রুচিসম্পন্ন গঠন ও সংস্কারমূলক বিষয়গুলোকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। কুরুচিপূর্ণ এবং অপসংস্কৃতির গন্ধযুক্ত বইপুস্তক প্রকাশ করা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করেছেন। তবে এসবের প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধে তিনি গঠনমূলক লেখা প্রকাশের বিরোধী ছিলেন না। এক কথায় প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আদর্শবাদী। বাংলাদেশে মাদ্রাসা তথা ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন সংস্কার আন্দোলন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন, মাদ্রাসা, শিক্ষক, ছাত্রদের নানা সমস্যা ও দাবি-দাওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার নেতা হিসেবে এবং সমগ্র কর্মজীবনে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সর্বদাই ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। ইসলামবিরোধী নানা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি সামাজিক নানা অপরাধ-অনাচারের বিরুদ্ধে তার পত্রিকাগুলোকে সরব রেখেছেন, তেমনি সাংগঠনিক তৎপরতায়ও তার গঠনমূলক ভূমিকা প্রেরণাদায়ক। তিনি বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সমিতি ও জমিয়াত প্রভৃতির উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি, সহ-সভাপতি, সম্পাদক, উপদেষ্টা, সদস্য ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন মোতামারে আলমে ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেক্রেটারি জেনারেল এবং সউদী আরবভিত্তিক রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সদস্য ছিলেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো ছাড়াও বহু মুসলিম দেশে অনুষ্ঠিত বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি অসংখ্যবার হজ-ওমরা ও হারামাইন শরীফাইন জিয়ারত করেন। তিনি বাগদাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পপুলার সম্মেলনেরও সদস্য ছিলেন। আরব দেশের পত্র-পত্রিকায় তার জীবনীও প্রকাশিত হয়েছিল। মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (র.)-এর নেতৃত্বে বাগদাদ সফরকারী বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলগুলোর মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন।
মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জীবনভিত্তিক একটি জীবন্তিকা সম্ভবত কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। এটি মরহুমের জীবনের বিভিন্ন দিকের ওপর অনেকের স্মৃতি চারণ/ রচনা সংকলিত। মাওলানা খানের আত্মজীবনীমূলক পুস্তকটির নাম ‘জীবনের খেলাঘরে।’ এর প্রথম প্রকাশ ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২৬২ পৃষ্ঠাব্যাপী এটি তার পূর্ণাঙ্গ জীবন কথা নয়, এতে তার বংশের বিবরণ পরিচিতি এবং তার জন্ম থেকে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত অনেক গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য ও ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তার পরবর্তী জীবন কাহিনী লিখেছেন কিনা জানা নেই। ঢাকায় এই লেখকের সাড়ে পাঁচ দশক জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু সহৃদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ইন্তেকালের দুঃসংবাদে লেখক দারুণভাবে মর্মাহত। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
পরিশেষে মরহুমের ‘জীবনের খেলাঘরে’ আত্মকাহিনী হতে কয়েকটি লাইন সুধী পাঠকদের উদ্দেশে উদ্ধৃত করেছি, যাতে এ সাধক মাওলানার জীবনের অনুভূতির একটি বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করার মতো, তার উক্তি :
“কর্মজীবনের চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। বিগত অর্ধশতাব্দী কালের আমাদের সামাজিক উত্থান-পতনের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছি। অনেক প্রসিদ্ধ বুজুর্গ এবং পাশাপাশি ভেকধারী পীর-ফকিরের ক্রিয়াকর্ম কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। এখনও স্বঘোষিত মোজাদ্দেদে জমানের প্রাদুর্ভাব অহরহই দেখতে পাই। এদের সাথে আমার মরহুম আব্বা এবং তার বন্ধুবান্ধবের জীবন-যাত্রা, চিন্তা-চেতনা এবং আমল-আখলাকের তুলনা করলে শুধু হতাশাই বাড়ে। মনে হয়, সিংহের খান্দান ক্রমেই যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর তাদের পরিত্যক্ত স্থানে এসে ভিড় করছে ফেউ জাতীয় মেরুদ-হীন ধূর্ত কিছু ইতর প্রাণী। বাংলার মুসলমান আজ নানামুখী বিজাতীয় আগ্রাসনের করুণ শিকার। কিন্তু এই মহাদুর্দিনে তাদের পাশে একজন মুন্সী মেহেরুল্লাহ বা নিদানপক্ষে একজন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও নেই।
এটা কিসের আলামত, সম্পূর্ণ ধ্বংসের, না অন্য কিছু তা একমাত্র রাব্বুল আলামিনই বলতে পারেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Reza ২৭ জুন, ২০১৬, ১২:৫৫ এএম says : 0
৮ খণ্ডের বিশাল তাফসীরে মারিফুল কুরআনকে এক ভলিয়মের ভেতর সংক্ষিপ্তকরণ নিতান্ত ধুসাধ্য। তাও আবার মাত্র ১৭ দিনে। মাওলানা মুহু উদ্দিন খান রহ: একমাত্র ব্যাক্তি, যার মাধ্যমে এ অনবদ্য কর্ম সম্ভব হয়েছিলো। আল্লাহ তাআলা হজরতকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন! আমীন।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন