শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বালিশকান্ড গণপূর্তকে ডুবিয়েছে

ফিরে দেখা ২০১৯ গলার কাঁটা মেগা প্রকল্প

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীম, বালিশকান্ড, গৃহায়ণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অভিযোগে গ্রেফতার এবং গণপূতেন প্রকৌশলীর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানসহ নানা ঘটনার মধ্যে বিদায় নিচ্ছে ২০১৯। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেওয়ার পরও ২০১১ সাল থেকে গুলশান-বনানীও বারিধারা লেক উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এছাড়া নানা কেলেঙ্কারি জড়িয়ে ছিল গৃহায়ণ ও গনপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকার শুদ্ধি অভিযান এই বছর শুরু করলেও মন্ত্রণালয়ে এখনও সেভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। দুদকের বড় অভিযান আতঙ্ক মধ্যে সারাবছর ছিল অস্বস্তি। এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও গণপূর্ত মন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির কোনো তোয়াক্কাই করেননি মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা। গত বছরের ১৮টি প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এখনো রাউউকে অভিযান শুরু হয়নি। সব কিছু মিলে বালিশ কান্ড গণপূর্তকে ডুবিয়েছে। ১৬ মেগা প্রকল্প গণপূর্তের গলার কাঁটা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী আগের ঠিকাদারের সাথে করা চুক্তি বাতিল করে নতুন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই মধ্যে গণপ‚র্ত অধিদফতর সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলো চালু করা সম্ভব হবে। যথাসময় কাজ সম্পন্ন করাটা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না বলেই মনে করছেন তারা।
টানা ১০ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমনে জোর দেওয়ার কথা বললেও বালিশকান্ডের মতো নতুন দুর্নীতির ঘটনা ঘটিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরে সারাবছর ছিল আলোচিত। তার পর একে পর এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ছিলো দুদকের বড় অভিযান। বালিশকান্ডের পর পর্দা ও বই কেনায় একই ধরনের দুর্নীতির খবর এসেছে।
সরকার ও দুদক তাদের নানা তৎপরতার খবর দিয়ে এলেও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণা সূচকে দুর্নীতি বাড়ার চিত্রই বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০১৮ সালের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার্লিনভিত্তিক সংস্থাটি যে প্রতিবেদন এবছর প্রকাশ করেছে, তাতে সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৪৯ নম্বরে। গতবার ছিল ১৪৩ নম্বরে।
১৬ মেগা প্রকল্প গণপূর্তের গলার কাঁটা
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আগারগাঁয়ে রাজস্ব ভবন, পঙ্গু হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, এনজিও ভবন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ভবন, বিজ্ঞান জাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাবের সদর দফতর, গাজীপুরের পোড়াবাড়িতে র‌্যাব ট্রেনিং সেন্টার, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবন, ক্যাবিনেট ভবন, বাসাবো বৌদ্ধমন্দির, পার্বত্য ভবন, মিরপুর-৬ নম্বরের স্টাফ কোয়ার্টার, সেবা মহাবিদ্যালয় এবং মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ জিকে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড করছে। এর মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪০০ কোটি টাকার কাজ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ৪০০ কোটি টাকার কাজ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডাইজেস্টিভ, রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালে (মহাখালী ডাইজেস্টিভ) ২০০ কোটি টাকার কাজ, অ্যাজমা সেন্টারে ২০-২৫ কোটি টাকার কাজ। এ ছাড়া জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০-২৫ কোটি টাকার কাজ, বাংলাদেশ সেবা মহাবিদ্যালয়ে ২০-২৫ কোটি টাকার কাজ, গাজীপুর র‌্যাব ট্রেনিং স্কুলের ৫৫০ কোটি টাকার কাজ, বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ৩০০ কোটি টাকার নির্মাণ কাজ, সচিবালয়ের ক্যাবিনেট ভবন নির্মাণে ১৫০ কোটি টাকার কাজ, এনবিআরের ৪০০ কোটি টাকার কাজ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সের ১০০ কোটি টাকার কাজ, পিএসসিতে ১২ কোটি টাকার কাজ ও এনজিও ফাউন্ডেশনে ৬৫ কোটি টাকার কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বিবেচনা করলে বাংলাদেশ আগের সপ্তদশ অবস্থান থেকে নেমে গেছে ত্রয়োদশ অবস্থানে। প্রায় ৬ হাজার টাকার একটি বালিশ ভবনে ওঠাতে খরচ প্রায় ১ হাজার টাকা- রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীদের আবাসন প্রকল্পের খরচের এমন হিসাব দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছিল। গত ১৯ মে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই কমিটির তদন্তেই রূপপুরে ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। হাই কোর্টের নির্দেশে জুলাই মাসে আদালতে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতির জন্য ৩৪ জন প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ওই প্রকল্পের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতার এই অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময় দাপুটে অনেক নেতা গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে মামলা হয়। পরে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তবান হওয়া ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাদের মধ্যে আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভ‚ঁইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভ‚ইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভ‚ইয়া, কলাবাগান ক্রিড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ, ঢাকার তিন কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব ও এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট, তার সহযোগী এনামুল হক আরমান, যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমান।
চলতি মাসের ১২ ডিসেম্বর পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ১৩ প্রকৌশলী ও ঠিকাদারকে আসামি করে মামলা করা হয়। আসামিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারেও পাঠানো হয়। বালিশকান্ডে রেশ না কাটতেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনাকাটায় আরেক দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর ভবনটির নকশা জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় ভবন মালিক, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রæপের চেয়ারম্যান এবং রাজউকের সাবেক দুই চেয়ারম্যানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুদক।
গণপূর্ত অধিদফতরের দুই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম ও মোসলেহ উদ্দীনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে ড. মঈনুল ইসলামকে আগামী ৫ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। পরে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের কাছে তলবি নোটিশ পাঠিয়েদেন এবং সম্পদবিবরণী চাওয়া হয়। এছাড়া গণপূর্ত অধিদফতরের আরো ছয় প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তু শুরু করে দুদক। তারা হলেন- প্রকৌশলী মো. সামছুদ্দোহা, মো. নজিবুর রহমান, মো. আবুল খায়ের, মো: শামীম আখতার ও মো: শফিকুল আলম।
গণপূর্তের দুই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী যুবলীগের নেতা ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) সিন্ডিকেটের সদস্য। জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে ড. মঈনুল ও মোসলেহ উদ্দীনের দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য পেয়েছে। ঠিকাদার জি কে শামীমকে সহযোগিতা, অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গণপ‚র্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দেসহ ১১ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। চলতি মাসের ১৮, ১৯ ও ২৩ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের অনুসন্ধান টিম তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের সম্পদবিবরণীও নেয়া হয়েছে। অন্য যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তারা হলেন তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন ও আবদুল মোমেন চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মো. ফজলুল হক, আবদুল কাদের চৌধুরী, আফসার উদ্দিন, মো. ইলিয়াস আহমেদ ও ফজলুল হক এবং গণপূর্ত সার্কেল ৪-এর উপসহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকার। গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা পড়েছে দুদকে। ঘুষ, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎসহ তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে সীমাহীন অভিযোগ। এদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুদক, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সচিব বরাবর অভিযোগ করেছে গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদাররা। ক্যাসিনোকান্ডে গ্রেফতারটন্ডার কিং জিকে শামীমের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র শাখা প্রধান মুমিতুর রহমান ও তার স্ত্রী জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পরে সিনিয়র শাখা প্রধান মুমিতুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন