ঢাকা কেন্দ্রীয়সহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে কয়েদি নির্যাতন, অনিয়ম আর দুর্নীতি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বন্দিদের খাবার, স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কারাগারে ভালো স্থানে থাকার ব্যবস্থা এবং তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া সবকিছু চলে টাকার বিনিময়ে। না দিলে কয়েদিদের দুর্বিষহ জীবন-যাপন করতে হয়। দাগী আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চিহিৃত আসামিরা কারাগারে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের বাইরে থাকা সিন্ডিকেট। মোবাইল ফোনে চাঁদাবাজির টাকায় সেখানেও (কারাগার) চলে তাদের নিরাপদে আয়েশী জীবন। আবার বিত্তশালী বন্দিরা টাকার জোরে চিকিৎসার নামে বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন বাইরের হাসপাতালে। অথচ সাধারণ বন্দিরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের সামান্য প্রাপ্যটুকু থেকে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এসব নির্যাতনে অনেক বন্দি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যারা এসব অনিয়ম দেখার দায়িত্বে রয়েছেন, সেই কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কারাগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কথিত ভিআইপি বন্দিদের এসব অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছেন । মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে এক শ্রেণির বন্দিদের তারা বিলাসী জীবন-যাপনে প্রয়োজনীয় রসদের পাশাপাশি নারীসঙ্গ লাভেরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের সহকারী কারা মহা-পরিদর্শক (প্রশাসন) মো. মাইন উদ্দিন ভ‚ঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, কারাগারের পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো। যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে বর্তমান কারা মহাপরিদর্শক তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সকল ধরনের অনিয়ম শক্ত হাতে দমন করা হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিনিয়র জেল সুপার ভালো বলতে পারবেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে বন্দিদের ভালো সেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া প্রসঙ্গে মাইনউদ্দিন বলেন, আসলে ক্ষমতার চেয়ে সব সময়ই এখানে দ্বিগুন বন্দি থাকে। এরপরেও যাতে কোনো ধরনের অনিয়ম না হয়, সেগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
কারাগারে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে জানানো হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয়ই কারাগারে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। অনেক বিষয়ের তদন্ত কখনো আলোর মুখ দেখে না। অনেকের শাস্তি বদলিতেই সমাপ্তি। অপকর্মের বিস্তর অভিযোগ থাকার পরও গুরুত্বপ‚র্ণ পদে বহাল রয়েছেন অনেকেই। কর্মকর্তাদের এহেন অপকর্মে অধিনস্থ কর্মচারীরাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। জেলার থেকে শুরু করে কারাগারের প্রতিটি নি¤œপদস্থ কর্মচারীও কোটিপতি। নামে-বেনামে তারা বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক। কারারক্ষীদের কেউ কেউ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায়, কারাগার পরিণত হয়েছে মাদকের স্বর্গরাজ্যে। এ কারণে দু’-একজন কারারক্ষী মৃদু শাস্তি পেলেও কারাগারের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না তেমনটা।
বন্দিরা কে কত টাকা দিতে পারছেন, তার ভিত্তিতে নির্ধারীত হয় তিনি কতটা সুযোগ-সুবিধা পাবেন। টেলিফোন, ক্যান্টিন, কোয়ারেন্টিন, চিকিৎসা এসব নিয়েও চলছে ব্যাপক বাণিজ্য। কারাগারের বিভিন্ন সেল, রুম থেকে আদায় করা হচ্ছে উচ্চ হারে ভাড়া। টাকা দিলে সেখানে সব মেলে। প্রভাবশালী বিত্তবান বন্দিদের জন্য সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা উন্মুক্ত। এ কথাগুলো বলেছেন সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ভুক্তভোগী বলেন, কারাগারে বছরজুড়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। পরিবেশ পরিস্থিতি বড়ই নিষ্ঠুর ও বেদনাদায়ক।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুর্নীতির ম‚ল কেন্দ্র হচ্ছে স‚র্যমুখী সেল। এই সেলকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তাদের সাত লাখ থেকে ৯ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। সেলটিতে অবস্থান করেন বিত্তবান বন্দিরা। বিত্তবান এবং বিশেষ সুপারিশের বন্দি ছাড়া ওই সেলে অবস্থানের সুযোগ নেই।
এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দৃশ্যমান অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দুঃশাসন, অত্যাচার, নিপিড়ন, নির্যাতন ও যৌনাচার প্রতিকার গ্রহণপূর্বক রাষ্ট্র ও জনবান্ধব পরিবশে তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো একটি আবেদনের অনুলিপি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন একাধিক বক্তি। সেখানে উল্লেখ করা হয়, হাজতী আসামিদের জেলখানার প্রবেশদ্বারে অধিক সময় বসিয়ে রেখে নগদ অর্থ দাবি করা হয়। টাকা না পেলে তাদের সাথে ভদ্রবেশি অত্যাচার করা হয়। ভিআইপি সিটের নামে ওখান থেকেই দায়িত্বরত কারা সংশ্লিষ্টরা হাজতীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। কর্ণফুলি সেলে থাকতে হলে হাজতী প্রতি সপ্তাহে পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়। ওয়ার্ড ইনচার্জ ও রাইটার এ টাকার রফাদফা করেন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও অন্যান্য ভবনেরও কথিত জমাদার দিন শেষে লকাফের সময় ওয়ার্ড ইনচার্জ-এর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে গ্রহণ করে। জেলের অভ্যন্তরে সিআইডির দায়িত্বে থাকা জমাদার দৈনিক ৪০ হাজার টাকা করে আদায় করে। অভিযোগ রয়েছে, কোনো হাজতীর কাছে মোবাইল সেট পেলে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া সিগারেট খেতে দেখলে নির্ধারিত ওয়ার্ড কিংবা মাঠে কোনো হাজতীকে দেখা মাত্রই আমদানি সেলে ঢুকানোসহ ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়। একজন সাধারণ বন্দি ওয়ার্ডে দিনে গোসল করলে ৪শ’ টাকা এবং কাটার, হিটার কিংবা প্রয়োজনীয় রশি ব্যবহার করলে ১শ’ টাকা করে দিতে হয়। একজন চিফ রাইটার হতে হলে তাকে ত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। কর্ণফুলি সেলের ইনচার্জদের মোটা আয়। ডেপুটি জেলার ও কয়েকজন কারারক্ষী মিলে একটি লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে জেলখানার ভেতর। হাজতীরা বাইরে টেলিফোন করলে দুই-চার মিনিটের জন্য ৫শ’ টাকা দিতে হয়।
এদিকে ভ‚ক্তভোগীরা বলেছেন, আমদানি সেল থেকেই ভালো থাকা, ভালো পরা ও ভালো খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় বন্দিদের। এই ভালো থাকা, খাওয়া ও পরার কয়েকটি শ্রেণি রয়েছে। সপ্তাহ হিসেবে নগদ টাকা নেওয়া হয়। সূর্যমুখী ও মধুমতিতে থাকতে হলে ১০ হাজার টাকা লাগে। বাড়তি আরো কিছু সুবিধা পেতে ভিআইপি বন্দিদের সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এসব ভিআইপি বন্দি সহজেই কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পান। সেখানে তারা কী সুবিধা লাভ করেন, তা নিয়ে অনেক গুঞ্জন আছে। টেলিফোন থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। সিমভিত্তিক ৪০ টার মতো ল্যাÐফোন চালু রয়েছে এ কারাগারে। এই ফোন কে কতক্ষণ ব্যবহার করবে তাও টাকার বিনিময়ে নির্ধারণ হয়ে থাকে। বেশি টাকায় ফোন ব্যবহারের বিষয়ে পর্যবেক্ষনমুক্ত থাকারও সুযোগ মেলে।
কারাগারের ক্যান্টিনও অবৈধ আয়ের আরেকটি উৎস। টাকা ছড়ালে এ ক্যান্টিনে সব কিছুই পাওয়া যায়। তবে বাইরের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। গরুর গোশত দুই হাজার টাকা কেজি। বন্দিদের জন্য সরকারের বরাদ্দ খাবার নিয়ে চলে হরিলুট। এ খাবার অযোগ্য। এই কারাগারে আরেক ভীতির নাম চিফ রাইটার। তার মাধ্যমেই লুটপাট ও লুটপাটের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে। বড় ধরনের অপরাধী হওয়াও চিফ রাইটারদের অন্যতম যোগ্যতা। চিফ রাইটারদের তিন নম্বর ফ্লোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এই ফ্লোরে কারা আইন অচল। এদের সহযোগিতা করেন সুবেদাররা।
আসামিদের বক্তব্য, থানায় এক জায়গায় টাকা-পয়সা দিলে চলে কিন্তু কারাগারে দিতে হয় পদে পদে। না হলে সেবা তো দ‚রের কথা, হয়তো খাওয়াই জুটবে না। কারাগারের কর্তা ব্যক্তিরা পুরনো আসামিদের দিয়ে ভয়-ভীতি বা জুলুম করে টাকা-পয়সা আদায় করে থাকেন।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারাগারগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য এর ভেতরে-বাইরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) টিভি সংযোগের ব্যবস্থাসহ উন্নত প্রযুক্তির মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করাও জরুরি। সেই সঙ্গে দ‚র করতে হবে জনবল সঙ্কট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন