স্বাভাবিক নিয়মেই ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ঝরে গেল আরও একটি বছর। বদলে যাওয়ার অঙ্গিকারে ২০১৯ কে বিদায় জানিয়ে বিশ্ববাসী বরণ করে নিল ২০২০ সাল। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য গেল বছরটি ছিল বেশ অর্থবহ। ২০১৯ সালে ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেমন সফল ছিল, ঠিক তেমনি ব্যর্থও। বিশেষ করে দেশের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল থেকে গেছে ব্যর্থতার বেড়াজালেই। তবে ফুটবলে ব্যর্থতা দিয়েই গেল বছরের শুরুটা হলেও বছর শেষে লাল-সবুজের ক্রীড়াবিদরা আলো ছড়িয়েছেন নেপাল সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে।
ব্যর্থতা দিয়েই শুরু ফুটবলের
ফেলে আসা বছরেও বাংলাদেশের ফুটবলে উন্নতির কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বছরজুড়ে হতাশার চিত্র ছিল ফুটবলাঙ্গনে। ধারাবাহিকভাবে লজ্জাজনক হার হেরেছে লাল-সবুজরা। কাতার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে যেমন হতাশাজনক পারফরম্যান্স, ঠিক তেমনি নেপাল সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসেও চরম ব্যর্থ বাংলাদেশ! ফিফা র্যাঙ্কিংয়েও তথৈবচ অবস্থা। গেল বছর এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব দিয়ে বাংলাদেশের ব্যর্থতা শুরু হয়েছিল। বাহরাইনে গ্রæপ পর্বের বাধা টপকাতে পারেনি বাংলাদেশ। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হয় লাল-সবুজের কিশোররা। কাতারে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্বে চার দলের মধ্যে চতুর্থ হয় বাংলাদেশ। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও ভরাডুবি। ভুটানের বিপক্ষে হেরে পয়েন্ট টেবিলে তলানিতে থেকে দেশে ফিরতে হয়েছে লাল-সবুজদের।
শুধু তাই নয়, বছরজুড়েই জাতীয় দলের ফুটবলারদের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। কাতার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১-০ গোলে, কাতারের কাছে ২-০ এবং ওমানের কাছে ৪-১ ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ জাতীয় দল।
ভাগ্য বদলায়নি এসএ গেমসেও
গেল বছরের শুরুর মতো শেষটাও ব্যর্থতায় কেটেছে লাল-সবুজ ফুটবলের। এসএ গেমসে খেলতে কাঠমান্ডুতে স্বর্ণ জয়ের লক্ষ্যে গেলেও ব্রোঞ্জ নিয়ে ফিরতে হয়েছে জামাল ভূঁইয়াদের। অথচ এই নেপালেই ১৯৯৯ সালে এসএ গেমস ফুটবলে সেরা হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০ বছর পর এসেও ব্যর্থতা দেখতে হয়েছে। দেশের ফুটবল কতটা পিছিয়েছে, তা কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন জামাল ভূঁইয়ারা। ভুটানের কাছে হারের পর স্বাগতিক নেপালের কাছে হেরে ব্রোঞ্জেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে জাতীয় দলের আদলে গড়া অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে।
ঢাকায় ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো
মাঠের খেলায় ব্যর্থ হলেও ফি-বছরের মতো সাংগঠনিক সাফল্য পেতে ২০১৯ সালে বেশ তৎপর ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্তারা। যার ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে তারা ঢাকায় উড়িয়ে আনেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোকে।
এই সময় হঠাৎ করেই একদিনের শুভেচ্ছা সফরে ইনফান্তিনো ঢাকায় আসেন। ঢাকায় ১৬ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন ফিফা সভাপতি।
ক্যাসিনো ঝড়ে টালমাটাল
গেল বছরের শেষ দিকে হঠাৎ করেই আলোচনায় আসে মতিঝিল ক্লাব পাড়ার ক্যাসিনো। মতিঝিল পাড়ার ক্লাবগুলোতে প্রতিদিন বসত ক্যাসিনো বা জুয়ার আড্ডা। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র্যাব) অভিযান চালায় মতিঝিল ক্লাব পাড়ার বেশ ক’টি ক্রীড়া সংগঠনে। একে একে ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল। বিসিএল এবং বিপিএলে খেলা ক্লাবগুলোর ক্যাসিনো কীর্তিও ফাঁস হলে স্তব্ধ হয়ে যায় দেশের ফুটবলাঙ্গন।
তবে ক্যাসিনো ঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়া ক্লাবগুলোর মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মোহামেডান। বলা যায় তাদের নবজাগরণ ঘটেছে। ক্যাসিনো কান্ডে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে মোহামেডানের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে র্যাব গ্রেফতার করলে স্থবির হয়ে যায় এই ক্লাবের ক্রীড়া কর্মকান্ড। ফলে নতুন মৌসুমে ফুটবল দল গঠন নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয় মোহামেডানকে। কিন্তু ক্লাবের এই বিপর্যয়ের দিনে পাশে এসে দাঁড়ান বাদল রায়সহ মোহামেডানের সাবেক ফুটবলার ও সংগঠকরা। তরুণদের নিয়ে লড়াই করার মতো একটি দল গঠন করেন তারা। বেশ ক’বছর পর জাঁকজমকপূর্ণভাবে উৎসব করে দলবদলের আনুষ্ঠানিকতা সারে মোহামেডান।
তীরন্দাজ রোমান সানাময় বছর!
গেল বছরের শুরু থেকে শেষ। আলোর ঝলকানি ছিল দেশসেরা তীরন্দাজ রোমান সানার উপর। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আসর থেকে বছরব্যাপীই পদক জিতে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হন তিনি। বছরজুড়ে তার সাফল্যে বলা যায় ২০১৯ সাল তীরন্দাজ রোমান সানাময় বছর! দেশ-বিদেশের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলে গেল ১২ মাসে ১৪টি পদক গলায় পড়েছেন বাংলাদেশ আনসারের আরচ্যার রোমান সানা। এই সাফল্যে ক্রিকেট, ফুটবল ও হকির বাইরে খেলাধুলার ভুবনটাকে শুধুই নিজের করে নেন রোমান। মার্চে ব্যাংককে এশিয়া কাপ আরচ্যারিতে রুপা জিতে শুরু করেন সাফল্য তোলা। জুনে নেদারল্যান্ডসে বিশ্ব আরচ্যারি চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠে ব্রোঞ্জ জিতে সরাসরি টোকিও অলিম্পিক গেমসে খেলার সুযোগ পান দেশসেরা এই আরচ্যার। সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনে এশিয়া কাপ র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে স্বর্ণ জেতার পর বছর শেষে এসে নেপাল এসএ গেমস আরচ্যারিতে তিনটি স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। বছরজুড়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোমান সানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সংবর্ধনা পেয়ে নিজেকে চিনিয়েছেন আলাদা করে। বছরজুড়ে আলোচনায় থেকে শেষদিন দেশকে আরেকটি সুখবর দিয়েছেন সানা। বিশ্ব আরচ্যারি বর্ষসেরার সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম উঠেছে দেশসেরা এই তীরন্দাজের।
নেপালে ১৯ স্বর্ণ
খেলাধুলার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশের স¤প্রীতির মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যেই ১৯৮৪ সালে শুরু হয় সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমস। তবে গেমসের গত ৩৫ বছরের ইতিহাসে এমন সাফল্য আগে কখনো পায়নি বাংলাদেশ যা গেল বছর নেপালে পেয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নেপালের কাঠমান্ডু ও পোখরায় শুরু হওয়া এবারের এসএ গেমসে ১৯টি স্বর্ণ, ৩২ রৌপ্য ও ৮৫টি ব্রোঞ্জপদক জিতে আগের নিজেদের সব সাফল্যকে ¤øান করেন লাল-সবুজের ক্রীড়াবিদরা। এর আগে ২০১০ সালে ঢাকা এসএ গেমসে সর্বোচ্চ ১৮টি স্বর্ণপদক জিতেছিল বাংলাদেশ। নেপাল এসএ গেমসে শুধু দলীয় সাফল্যই নয়, আরও একটি ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশের আরচ্যারি। পোখরায় গেমসের আরচ্যারি ডিসিপ্লিনের ১০টি ইভেন্টের সবকটিতেই স্বর্ণপদক জিতে ইতিহাস গড়েন বাংলাদেশের তীরন্দাজরা। এছাড়া গেমসে তায়কোয়ান্ডোকা দিপু চাকমা’র হাত ধরে বাংলাদেশ পায় প্রথম স্বর্ণপদক। ২০১৬ গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসের পর টানা দ্বিতীয় আসরে স্বর্ণ জিতে ইতিহাস গড়েন দেশসেরা নারী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। আরেক ভালোত্তোলক জিয়ারুল ইসলামের স্বর্ণ জয় দেশের ভারোত্তোলনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। তবে সবাইকে চমকে দিয়েছেন ফেন্সিংয়ের ফাতেমা মুজিব। নেপাল এসএ গেমসে প্রথমবার যুক্ত হওয়া ফেন্সিংয়ে স্বর্ণপদক জিতে দেশের মান বাড়ান তিনি। কাঠমান্ডুতে কারাতেকারাও সাফল্য পেয়েছেন নজরকাড়া। তিন কারাতেকা মারজান আক্তার প্রিয়া, হুমায়রা আক্তার ও আল-আমিনের হাত ধরে আসে তিনটি স্বর্ণপদক। জাজদের পক্ষপাতিত্বের জন্য বক্সিং ও উশু থেকে আরো দু’টি স্বর্ণপদক হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের। ভারতীয় সচিনের সঙ্গে ফাইনালে দুর্দান্ত খেললেও জাজ প্যানেলে বাংলাদেশের কোনো জাজ না থাকায় রুপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বক্সার রবিনকে। উশুকারাও সোনা বঞ্চিত হন জাজদের পক্ষপাতিত্বের কারণে।
নেপাল এসএ গেমসে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম আসেনি। গৌহাটিতে মাহফুজা খাতুন শিলা দু’টি স্বর্ণপদক জিতলেও এবার ব্যর্থ হয়েছেন বাংলাদেশের সাঁতারুরা। লন্ডন প্রবাসী সাঁতারু জুনাইনা আক্তার ও আরিফুল ইসলামকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেও তারা হতাশ করেছেন জাতিকে। রৌপ্য ও ব্রোঞ্জেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। গৌহাটিতে শ্যুটিংয়ে সোনা জিতলেও এবার কাঠমান্ডুতে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখিয়েছেন শ্যুটাররা। তিন বছর আগে স্বর্ণপদক জিতলেও এবার ব্যর্থ হয়েছেন পিস্তল শ্যুটার শাকিল আহমেদ ও রাইফেল শ্যুটার আবদুল্লাহেল বাকী। অ্যাথলেটিক্সে হাইজাম্পার মাহফুজুর রহমানের রুপাই ছিল বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। নারী কাবাডি রৌপ্যপদক হাতছাড়া হয়েছে। তবে ব্রোঞ্জ জিতেছে নারী কাবাডি দল। শূণ্যহাতে ফিরেছে ভলিবল। পুরুষ হ্যান্ডবলও তাদের পদক হাতছাড়া করেছে এবার। ব্যাডমিন্টনে একমাত্র পদক মিশ্র দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ। টেবিল টেনিসের সেরা অর্জন একটি ব্রোঞ্জপদক।
অন্যান্য সাফল্য
গেল বছর বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলেন ফাহাদ রহমান। ফেলে আসা বছরেই বাংলাদেশ নারী হকি দল (অনুর্ধ্ব-২১) প্রথমবার আন্তর্জাতিক আসরে খেলেছে। সেপ্টেম্বরে তারা সিঙ্গাপুরে জুনিয়র এএইচএফ কাপে অংশ নিয়ে দেশের নারী হকিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে রুপা জিতেছেন মিস্টার বাংলাদেশ রবিন। আর ইরানে প্রথম জুনিয়র বিশ্বকাপ কাবাডিতে অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জ পায় বাংলাদেশ। তবে বছরের শেষ দিকে এসে টেনিসে ঘটেছে অপ্রতিকর ঘটনা। যৌন হয়রানির অভিযোগে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোরশেদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রীড়াঙ্গনে হইচই ফেলে দেন আমেরিকা প্রবাসী এক নারী খেলোয়াড়।।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন