বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ঢাকা সিটি নির্বাচন ও ইভিএম বিতর্ক

আজম জহিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৩ এএম



সনাতন ধর্মের লোকদের স্বরসতী পূজার কারণে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ পেছাতে বাধ্য হয়েছে নির্বাচন কমিশন। যদিও কমিশন অনড় ছিলো নির্ধারিত তারিখেই নির্বাচন করবে বলে। ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন দুদিন পিছিয়ে ১ ফেব্রæয়ারি নির্ধারণ করায় একটি অহেতুক বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। সনাতন ধর্মের লোকজনও দাবি জানিয়ে আসছিল একই দিনে পূজা ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশংকা করছিল। স্পর্শকাতর এই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্তও গড়ায়। পাশাপাশি ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষাও দুদিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ১ তারিখের পরীক্ষা যথারীতি ৩ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দেশের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কিনা, ভোটাররা নির্বিঘেœ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কিনা এবং ইভিএম ব্যবহারের ফলে একজনের ভোট অন্যজনের মার্কায় চলে যাবে কিনাÑ এসব প্রশ্ন ভোটারদের মনে বারবার উঁকি দিচ্ছে। এখনও তারা দ্বিধাদ্ব›েদ্ব আছে নির্বাচনের দিন দুই সিটিতে কী হতে যাচ্ছে! নির্বাচনের নামে প্রহসন নাকি সুষ্ঠু ভোট হতে যাচ্ছে?

নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি অর্থাৎ বড় তিন দলই আচরণবিধি লংঘন করে চলেছে। এর মধ্যে পোস্টার ছেড়া, নির্বাচনী কাজে বাধা দেয়া, গণসংযোগের সময় হামলা, গাড়ি ভাঙচুরসহ নানা কর্মকাÐের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রতিদিনই নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। বড় দু’দল থেকে শুরু করে অন্যান্য ছোটখাটো দলও নির্বাচন কমিশনে আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ তুলে ধরেছে। দুই সিটির কোথাও কমিশনের বেঁধে দেয়া আচরণবিধি মেনে চলছেন না প্রার্থী ও তার সমর্থকরা। কমিশনে অভিযোগ করেও প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছে না কোনো দলই। নির্বাচন কমিশন যেন ‘কানে দিয়েছে তুলো, পিঠে বেঁধেছে কুলো’।

এদিকে ইভিএম নিয়ে সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগ বাদে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই। তারা ইভিএম নামের এই যন্ত্রটিকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস এবং আস্থায় নিতে পারছে না। ভোটারদের মনেও সংশয় কাজ করছে পছন্দের প্রার্থীকে তারা নির্দ্বিধায় ভোট প্রয়োগ করতে পারবে কিনা। ইভিএম যন্ত্র সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে, এই যন্ত্রের সাহায্যে ভোট দিলে সেই ভোট পছন্দের প্রার্থীর বাক্সে যাবে, না ইঞ্জিনিয়ারিং করে তার ভোট অন্য প্রার্থীরা নিয়ে নেবে? এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে নির্বাচনের জন্য ৩৫ হাজার ইভিএম প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রয়োজনীয় ইভিএম ছাড়াও ৫০ শতাংশ বেশি ইভিএম প্রস্তুত থাকবে। প্রতি কেন্দ্রে ইভিএমের টেকনিক্যাল সাপোর্টের জন্য দুজন করে সেনা সদস্যও কাজ করবে।

এই ইভিএম নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘ইভিএম ভোটাধিকার হত্যার এক নিঃশব্দ দুরভিসন্ধি প্রকল্প। নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ভোটের দাবি করেন তিনি।’ মির্জা ফখরুলের কঠোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ঢাকা সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের আঁচ পেয়ে বিএনপি নেতারা আবোল-তাবোল বকছেন। যে কারণে তাদের মুখে পরাজয়ের সুর।’ এদিকে ইভিএম নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলে ফেলেছেন, ‘বুথ দখল করে ইভিএমে জাল ভোট দেয়া সম্ভব।’ অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, ‘আমি নিজেই মনে করি, সিটি নির্বাচনে লেভেল ফিল্ড বলে কিছু নেই। লেভেল ফিল্ড কথাটা এখন একটা অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে।’ গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, ‘দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করা হচ্ছে। ইভিএম হলো ইলেক্ট্রনিক ভোট ফ্রড (এইভিএফ)।’ ইভিএমকে গজব বলে মন্তব্য করে নাগরিক ঐক্যের আহŸায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘মানুষ যা তৈরি করে তা নিজের জন্য তৈরি করে। নির্বাচন কমিশনকে পেছন থেকে কেউ ইভিএম আমদানি করিয়েছেন ওদের নিজেদের জন্য।’ ইতিপূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা বলেছিলেন, সব দল চাইলে ইভিএমে ভোটিং হবে, না চাইলে না। এখনতো সরকারি দল আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপিসহ অন্যান্য দল ইভিএমকে ‘না’ বলে আসছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কী কারণে, কাদের স্বার্থে বা কাদের ইঙ্গিতে এই যন্ত্রটির ব্যবহার থেকে সরে আসছে না কমিশন?

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে, নির্বাচনী মাঠের সুন্দর পরিবেশ। তারপর আছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা। এ দুটির সমন্বয় না হলে যত চেষ্টা করাই হোক না কেনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না। আজকে ঢাকা সিটির যে চিত্র আমরা দেখছি তাতে মনে হয়, না নির্বাচন নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। যদিও সরকার দলের নেতারা আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে এবং ফলাফলই যা-ই আসুক সরকারি দল তা মেনে নেবে। মানুষ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটাররা যেন কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ও ভয়ভীতি ছাড়াই তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সিটি মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত করতে পারেন।
পত্রপত্রিকার রিপোর্টে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১৯২ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে আছে ভাঙচুরের মামলাও। আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি এবং নারী নির্যাতনের মামলা। আর বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের নামে রয়েছে ভাঙচুর-সহিংসতা ও সরকারি কাজে বাধাদানের মামলা। ঢাকা উত্তরের ৩২৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে মামলা আছে ৮৭ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ১০ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর প্রার্থীও আছেন। দক্ষিণের ৪১৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ১০৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন ৮ জন। এসব মামলা মাথায় নিয়েই মেয়র, কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঠের আধিপত্য বজায় রাখতে চলছে অস্ত্রের মহড়াও। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ মাঠে নেমেছে তার পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে। ভোটের মাঠে অপরাধীদের অবাধ চলাচলে পুলিশ ও গোয়েন্দারাও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এই সুযোগে অনেক প্রার্থী কালো টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছেন নির্বাচনী মাঠে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ারাও ঘরে বসে নেই। তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে সন্ত্রাসী ও নাশকতার আশংকা করছে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন। এদের শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করাসহ মাঠের সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে না পারলে সবকিছু অন্য রকম হয়ে যেতে পারে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনসহ সব রাজনৈতিক দলকে দুই সিটি নির্বাচনে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হবে। নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে জন্য ইভিএম বাতিলসহ স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোটাধিকার প্রয়োগ, ভোটারদের কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা, জালভোট প্রতিহত, কেন্দ্র দখল বন্ধ, সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের প্রতিরোধ এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, ছড়াকার, নাট্যকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন