মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম
লাইলাতুল কদর
লাইলাতুল কদর অর্থাৎ মহিমান্বিত রজনী সাধারণভাবে শবে কদর নামেও অভিহিত। আরবি শব্দ ‘লাইল’ ফারসি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘কদর’ অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত, সম্মানিত। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত বা মহিমান্বিত রাত। বৎসরের এই রাতটি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ এবং প্রিয় রজনী। উম্মতে মোহাম্মদী (সা.)-এর নিকট এটি আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বিশেষ উপঢৌকন এ মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে আল্ কোরআনে ঘোষিত হয়েছে। রমজান আরবি হিজরি সনের মাসগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই মাসেই নাজিল হয়েছে মানবজাতির হেদায়েতের বিধান আল্ কোরআন। এরশাদ হয়েছে, “রমজান সে-ই মাস যাতে নাজিল হয়েছে আল্ কোরআন, যা মানুষের জন্য দিশারী এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মানদ-।” (সূরা বাকারা-১৮৫) আরো এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমি এই (গ্রন্থ) টিকে নাজিল করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে। তুমি কি জান সেই মর্যাদাপূর্ণ রাত কি? এই মর্যাদাপূর্ণ রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সূরা আল্ কদর : ১Ñ৩) রাসূল (সা.) বলেছেন, “দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহপাক পয়গম্বরদের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন তা সবই রমজান মাসেই নাজিল করেছেন।” পবিত্র কোরআন এই মাসে নাজিল হওয়ার কারণে মাহে রমজানের এত মর্যাদা ও সম্মান। আল্ কোরআন আল্লাহর দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত ও নেয়ামত। এরশাদ হয়েছে, “এই কোরআন অসীম দয়াময় আল্লাহ শিখিয়েছেন।” (সূরা আর-রাহমান-১০২) হযরত জিবরাইল (আ.) রমজান মাসের প্রতি রাতে রাসূল (সা.)-কে কোরআন শিক্ষা দিতেন। (বুখারি ও মুসলিম) হযরত ফাতেমা (রা.)-এর অপর বর্ণনায় এসেছে, হযরত জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর রমজান মাসে একবার রাসূল (সা.)-এর নিকট কোরআন আবৃত্তি করতেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের বছর দু’বার রাসূল (সা.)-এর নিকট কোরআন পেশ করেন। কাজেই কোরআনের বদৌলতেই রমজানের মর্যাদা। রমজান মাসের লাইলাতুল কদরেই কোরআন নাজিল হয়েছে বলে আল্ কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব
মুসলিম সমাজ রমজানের রোজা রাখার মাধ্যমে এ রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাই ইসলামে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। রোজাদার মুসলমানা এ রাতকে পেয়ে নিজেকে একজন আল্লাহর বান্দাতে পরিগণিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন। আল্ কোরআনে লাইলাতুল কদরের অনন্য মর্যাদায় একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা রয়েছে। এ সূরা থেকে এর গুরুত্ব অনুভব করা যায়। এ রাতে কালামে রব্বানী নাজিল হয়। এ রাত হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে জিবরাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের একটি দল ধূলির ধরায় অবতরণ করেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ রাতে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে।” (বুখারি) অন্য হাদিসে আছে, “রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাযা) অন্য এক হাদিসে আছে, হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেন, “কদর রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) একদল ফেরেশতা নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। তারা সকল লোকের জন্য দু’আ করে থাকেন, যারা এ রাতে দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় ইবাদতে লিপ্ত থাকেন।” (বায়হাকী) লাইলাতুল কদরকে “লাইলাতুল হাকাম বা সিদ্ধান্তের এবং লাইলাতুল তাকদীর বা ভাগ্য নির্ধারণের রাতও বলা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়Ñ লাইলাতুল কদরে মানুষের জীবনকাল, মৃত্যু, রিজিক এবং বৃষ্টিপাত ইত্যাদির মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এমনকি পরবর্তী হজের সময় হাজিদের সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের ছায়া লিপি ফেরেশতাদেরকে প্রদান করা হয়। তাকদীরের সিদ্ধান্ত লাইলাতুল কদরে কার্যকরের দায়িত্ব ফেরেশতাদের উপর অর্পিত হয়।” (তাফসীরে রুহুল মা’আনী)
কদরের রাত কোনটি
লাইলাতুল কদরের রাত কোনটি তা নিয়ে মত ভিন্নতা চলে আসছে সাহাবায়ে কেরামদের সময়কাল থেকেই। আমাদের দেশে ২৬ রমজান দিবাগত রাত তথা ২৭ রমজানকেই নির্ধারণ করে পালন করা হয়। ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকগণও বেশিরভাগ ওই দিনকেই সমর্থন করেন। উবাদা ইবনে সামেত (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, “কদরের রাত হল রমজানের শেষ ১০ রাতের মধ্যে এক বেজোড় রাত। অর্থাৎ হতে পারে তা ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯-এর মধ্যে যে কোন রাত।” (মুসনাদে আহমাদ) হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, “লাইলাতুল কদরকে তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতের মধ্যে বেজোড় রাতে তালাশ কর।” (বুখারি, মুসলিম ও তিরমিযী) হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, “আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি কদরের রাত্রের ভোরে পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করছি। তিনি ২৩ রমজানের ভোরে সালাত শেষে প্রত্যাবর্তনকালে তাঁর কপালে পানি ও কাদার চিহ্ন দেখা যায়।” (মুসলিম) ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, “এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) আমি একজন বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি। আমার জন্য রাতের সালাত খুব কষ্টকর। আমাকে এমন রাতের আদেশ দিন যে রাত হবে কদরের রাত। তিনি বললেন, তুমি ২৭ রমজানের রাতকে আঁকড়ে ধর।” (মুসনাদে আহমদ) সুতরাং এই আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, কদর রাত্রির সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে এবং নির্দিষ্ট তারিখ না হওয়ার পেছনে আল্লাহতায়ালার রহমত ও বরকত রয়েছে। ওলামায়ে কেরাম বলেন, এর ফলে মানুষের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং মুসলমানগণও বেশি বেশি ইবাদত করতে পারবেন।
এই রাত কেন এত মহিমান্বিত-কয়েকটি অভিমত
ইমাম যুহুরী (র.)-এর মতে, “আল্লাহর যাবতীয় দিনকালের মধ্যে এ রাতটি সর্বাধিক মর্যাদাশীল, মাহাত্ম্যপূর্ণ, বৈশিষ্ট্যম-িত ও মহিমান্বিত বলে এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর।” আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর মতে, “লাইলাতুল কদর অর্থ এমন রাত বুঝায় যাতে যাবতীয় ব্যাপারে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এগুলোর চূড়ান্ত রূপদান করা হয় এবং এক বছরের জন্য সব বিধান ও মর্যাদার ফয়সালা আল্লাহ এ রাতে জারি করে দেন।” (শরহে বুখারি আইনী) আবু বকর আল্ ওয়াররাকের মতে, “এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর রাখার কারণ হল, যে লোক মর্যাদাশীল নয় সে যদিও এ রাতকে যথার্থভাবে গ্রহণ করে এবং রাত জাগরণ করে আল্লাহর ইবাদত করে তাহলে সেও মর্যাদাশীল হতে পারে।” এছাড়াও বলা যায়, এ রাতে মু’মিন ব্যক্তি যে নেক আমল করে তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হওয়ার কারণে সে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী হয় বলে এ রাতের নাম দেয়া হয়েছে লাইলাতুল কদর। হাজার মাসের তুলনায় এ রাত উত্তম হওয়ায় এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর হওয়া যুক্তিযুক্ত। সবচেয়ে মর্যাদাশীল কিতাব মহাগ্রন্থ আল্ কোরআন এ রাতে অবতীর্ণ হওয়ায় এ রাত কদর বা অতি মর্যাদার রাতরূপে অভিহিত হতে পারে। হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহর মতে, “আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণের পরিমাণ এ রাতে নির্ধারণ করেন বলে এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর বা নির্ধারণী রজনী।
এ রাতের ইবাদত ও দোয়া
রাসূল বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে আখেরাতে মুক্তির আশায় কদরের রাতের ইবাদত করবে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (বুখারি) রাসূল (সা.) নিজের পরিবারবর্গকে রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে জাগিয়ে দিতেন এবং সাহাবারাও তা ইত্তেবা করতেন। তাই আমাদেরও উচিত রাসূল (সা.)-এর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে কোরআন নাজিলের এই মাসে বেশি বেশি কোরআন পাঠ, দান-সদকা, যিকির-আযকার এবং নফল ইবাদত করা। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “আমি একদা রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কি দোয়া করব? তিনি বললেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।’’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি মহীয়ান, ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতেই তুমি ভালবাসো, আমাকে ক্ষমা কর। আসুন আমরা সবাই এই মহান রাতকে কাজে লাগিয়ে ইবাদত বন্দেগী করে, আল্লাহর দরবারে তওবা করে অতীতের কৃত গুনাহ থেকে ক্ষমা চেয়ে জীবনকে পুত-পবিত্র করে তুলি।
লেখক : সম্পাদক, ইদানীং লিটল ম্যাগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন