শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভরণপোষণ পাওয়া পিতা-মাতার নৈতিক ও আইনি অধিকার

মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

সব ভালবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকলেও সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসায় কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। জীবন দিয়েও সন্তানদের সুখী করতে চান বাবা-মা। শিশুর বয়স বেড়ে ওঠার পর বাবা-মার দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মা তার সন্তানের লেখাপড়ার অভ্যন্তরীণ সর্বদিকে দৃষ্টি রাখেন, আর বাবা তার শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ সংস্থানে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে তাদের যদি কিছু অসুবিধা হয়েও থাকে তা তারা সন্তানের মুখ পানে চেয়ে হাসিমুখে বরণ করে নেন। সন্তান বিপদগামী হয়ে পড়ছে কি-না, আদব-কায়দার বরখেলাপ করে কি-না, এ সকল দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত’। সন্তানের নিকট বাবা-মার চাওয়া-পাওয়া একটাই যা হলো, সু-সন্তান হয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করা। যদি কোন সন্তান সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সুনাম অর্জন করতে পারে তাহলে বাবা-মার আনন্দের সীমা থাকে না। সকল বাবা-মাই চান তার সন্তান শিক্ষিত, আদর্শবান ও চরিত্রবান হয়ে সমাজে দশজনের মুখে প্রশংসিত হোক। সুতরাং এমন পরম হিতৈষীর জন্যে সন্তানদেরও করণীয় রয়েছে। তাদের সেবাযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রু টি করতে নেই। বাবা-মা যেন নিজেদের উপেক্ষিত বলে মনে না করতে পারেন তার প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। যাদের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালবাসায় আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তারা অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা আমাদের সকলের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বাবা-মাকে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য আদালতে যেতে হচ্ছে। পরিবর্তিত জীবনযাত্রায় মানুষের মানসিক মূল্যবোধ এবং চিন্তার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের দিনে এক অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পরিবার একক পরিবার, মা-বাবা আর তাদের এক জোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায়, যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্ততিরা এক নিজস্ব মনোজগত সৃষ্টি করে নেয়।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে মানবিক সম্পর্ক এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়েছে কষ্টকর। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়, যা হওয়া উচিত নয়, বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। লক্ষ্যণীয়, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি, সন্তান উচ্চ শিক্ষিত, ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত; কিন্তু বাবাকে ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে দুর্বহ জীবন কাটিয়ে দিতে হচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রম নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নিজ পরিবারে। পৃথিবীর সকল ধর্ম গ্রন্থে বাবা-মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বাধ্যকারী নির্দেশনা আছে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন ও নবীজির হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বহুবার বহুভাবে বাবা-মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে।

মহান আল্লাহ বলেন, “আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং বাবা-মার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল।” রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ীও বাবা-মাকে ভরণ-পোষণ দিতে সন্তান বাধ্য থাকবে। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো বাবা-মা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। অবহেলিত বাপ-মার দুঃখ কষ্ট লাগব করার জন্যে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করে।

পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তাঁর বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তাঁর মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন। আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণপোষণ করতে হবে না। উক্ত আইনের ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হবে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তাঁরাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাঁদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। সবশেষে বলব, শুধুমাত্র আইন দিয়ে এ অমানবিক বিষয় রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় অনুশাসনও মেনে চলা। আমাদের সকলেরই বাবা-মার প্রতি কর্তব্য পরায়ন হওয়া উচিত।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন