প্রতিদিনই বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের সংখ্যাও। গত এক-দেড় বছরে যুক্ত হয়েছে মোবাইল অ্যাপ-ভিত্তিক মোটরসাইকেল পরিবহন সেবা।
সড়কের পাশে দাঁড়ানো মোটরসাইকেলে ঝোলানো অতিরিক্ত একটি হেলমেট দেখে সহজেই অনুমান করা যায় চালকরা কোনো রাইড শেয়ার কোম্পানির হয়ে সড়কে নেমেছেন। এইসব মোটরসাইকেল চালকরা ফোন পেলে যাত্রীকে আনতে ছোটেন। অনেক সময় পথচারীকেও জিজ্ঞাসা করেন কোথায় যাবেন? সড়কে এই সেবা সুবিধা নিয়ে এলেও বেড়েছে জঞ্জাল। যানজটে রুদ্ধ হলেও বাইকাররা চলেন ফুটপাত মাড়িয়ে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সড়কে বেপরোয়া গতিতে চলছেন মোটরসাইকেল চালকরা।
অনেক ক্ষেত্রে তারা সিগন্যাল তো দূরের কথা ভিআইপি সিগন্যালও মানেন না। আর রাজধানীর অধিকাংশ সড়কের ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানো যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। ফুটপাতে মোটরবাইক চলাচল করায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) হিসেবে দেখা যায়, প্রতিদিন ২৭১টি, প্রতি মাসে ৮ হাজার ১৪০টি নতুন মোটরসাইকেল নামছে ঢাকার রাস্তায়। ২০১৮ সালে সারাদেশে নিবন্ধন পেয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৬৯৪টি মোটরসাইকেল। সে হিসেবে দেশে প্রতিদিন ১ হাজার ৫৫টি নতুন মোটরসাইকেল রাস্তায় নেমেছে। বাহনটি দিনে দিনে যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে, তেমনি চালকদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া আচরণের অভিযোগও জোরালো হচ্ছে।
গত কয়েকদিনে বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চালানোর চিত্র দেখা গেছে, পুলিশের সামনেই দ্রæত গতিতে চলে যাচ্ছেন মোটরসাইকেল চালকরা। তীব্র হর্ন দিয়ে দুরন্ত গতিতে ফুটপাথের ওপর দিয়েই চলাচল করছে। কোন কোন তরুণ আঁকাবাঁকা করে দ্রæত গতিতে বাইক চালাচ্ছে। এভাবে চলাচলের কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি পাখির মোড় এলাকায় দেখা গেছে মোটরসাইকেলের বিকট আওয়াজে চালিয়ে নিজেদের জানান দিচ্ছেন কিশোর-তরুণেরা।
তরুণরা মোটরসাইকেল চালক, যারা হিন্দি গান, গুলির শব্দ, জীবজন্তুর বিকট শব্দ বা ভিআইপি সাইরেন বাজিয়ে বাইক চালায়। তাদেরই একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, এ ধরনের শব্দ করলে আলাদা মনোযোগ তৈরি করা যায়। পথে চলতি অবস্থায় ভয়ে অনেকে সাইড দিয়ে দেয়। আর গান শুনে গাড়ি চালালে নিজেকে স্মার্ট মনে হয়।
জানা যায়, থাইল্যান্ড থেকে যে মোটরসাইকেলগুলো আনা হচ্ছে সেগুলোয় সাউন্ড হল্যার থাকায় চালানোর সময় ইঞ্জিনের উচ্চ শব্দ তৈরি হয়। অনেকেই থাইল্যান্ড থেকে পশু-পাখির বিকট ডাকের হর্ন নিয়ে আসেন। আর তরুণদের অনেকেই এ হর্ন লাগাতে দোকানে লাইন দেয়। এ ছাড়া আজকাল রাস্তায় প্রায়ই ভিআইপিদের চলাচলের সময় ব্যবহৃত সাইরেনও মোটরসাইকেলের হর্ন হিসেবে করতে দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ব্যস্ত এলাকা কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট। শিশু সন্তানকে নিয়ে সড়কের পাশে বাসের জন্য অপেক্ষায় এক নারী। হঠাৎ বিকট শব্দে বেসামাল গতিতে পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে গেলেন উঠতি বয়সী তরুণ। ভয়ে কান্না শুরু করল শিশুটি। এমন অবস্থায় মোটরসাইকেল আরোহীর ওপর সব ক্ষোভ ঝাড়লেন শিশুটির মা।
সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর সড়কগুলোতে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করার ব্যবস্থা রয়েছে এর ১০ গুণ বেশি যানবাহন চলে। অধিকাংশ এখন মোটরসাইকেল দখল করে নিয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ৩ লাখ ৩২ হাজার মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন বেড়েছে প্রায় ৪০শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ নিবন্ধিত মোটরযান আছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ বিভাগের সাবেক শিক্ষক এমরান কবির বলেন, শুধুমাত্র স্পিডের কারণেই মোটরবাইক সব থেকে মারাত্মক যানবাহন। টপ স্পিড তোলা একটা ফ্যাশন বা বাহাদুরি হিসেবে নিচ্ছেন অনেক বাইকার। চার চাকার বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০গুণ বেশি। মানুষ নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ বাহনটির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
মোটরসাইকেল চালক আলমগীর দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সড়কের পাশে কয়েক ফুট জায়গা ছেড়ে দিলেই তো মোটরবাইকগুলো চলাচল করতে পারে। অথচ মোটরসাইকেল যাতে ফুটপাতের উপর দিয়ে চলাচল করতে না পারে সেজন্য ২০১২ সালে হাইকোর্টে নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না মোটরবাইক চালকরা।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাকে বলেন, বেপরোয়া কিংবা ফুটপাথে মোটরবাইক চালানোর বিরুদ্ধে সড়ক মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু আরোহীদের সচেতনতা এবং মানসিকতা না বদলালে এটি পুরোপুরি বন্ধ করা মুশকিল বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন