মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কোন পদক্ষেপই সফল হচ্ছে না। বরং দিন দিন মশার যন্ত্রণা বেড়েই চলছে। মশা নিধনে চলতি অর্থ বছরে ৯২কোটি ৬০ লাখ টাকা বাজেট বরাদ্ধ রেখেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দফায় দফায় চালানো হচ্ছে বিশেষ কর্মসূচী। কিন্তু এতেও কোন কাজ হচ্ছে না। এডিস মশার উপদ্রব কমতে না কমতে শুরু হয়েছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে রাজধানীতে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহীত নানা রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। বর্তমানে নগরীতে মশার উপদ্রব বাড়লেও মশক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বিকার। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশন বলছে, ময়লা পানিতে কিউলেক্স মশার উৎপত্তি হলেও ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা পরিস্কার পানিতে জন্ম নেয়। যা মানুষের বসত বাড়ি ও বিভিন্ন অফিসই এর প্রজনন ক্ষেত্র। এ মশা শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন নাগরিকদের সচেতনতা।
গত বছরটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই ডেঙ্গুর বছর। সরাদেশে এক লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। দেশজুড়ে ডেঙ্গু রোগের এমন প্রাদুর্ভাব দেশের ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। আর এর শুরুটা হয়েছিল বছরের মাঝামাঝি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শুরুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কথা অস্বীকার করলেও সমালোচনার মুখে পরে তা স্বীকার করে নেন। এরপর মশা নিধনের সব আয়োজন সম্পন্ন করে দুই সিটি কর্পোরেশন। পুরনো ওষুধে কাজ না হওয়ায় বিদেশ থেকে বিমানে উড়িয়ে আনা হয় মশা মারার নতুন ওষুধ। পাশাপাশি এ সেক্টরে যুক্ত করা হয় আধুনিক যন্ত্রপাতি। বাড়ানো হয় বরাদ্দও। কিন্তু মশা কমেনি, উল্টো আরও বাড়ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন মশা নিধনে মূল কাজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে লোক দেখানো কর্মসূচিতে ব্যস্ত। তাছাড়া কাজের ফল আসছে কিনা সে বিষয়েও কোনও তদারকি নেই। ফলে চলতি বছর এ রোগের ভয়াবহতা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
এবছরও শীতের শুরু থেকেই রাজধানীতে মশার উপদ্রব যায়। সিটি কর্পোরেশন এবারও কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এতে আবারও কিউলেক্স মশার কামড়ে জাপানিজ এনসেফালাইটিসের মতো মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করছেন রাজধানীবাসী। তাদের মনে প্রশ্ন মশা নিধনে দুই সিটি কর্পোরেশনের কোটি কোটি টাকার বাজেট কোথায় যায়।
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এডিসের সঙ্গে কিউলেক্স মশার যন্ত্রণাও কম নয়। শুধু এডিস নিয়ে ভাবলে চলবে না, আমাদের কিন্তু কিউলেক্স মশার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এটা থেকেও জাপানিজ এনসেফালাইটিসসহ (জেই) আরো কয়েকটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। বিশেষ করে আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরেই ‘জেই’ আছে। ফাইলেরিয়াও আছে।
রাজধানীর কয়েকটি এলকা ঘুরে এবং বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই মশার উপদ্রব। কয়েল জ্বালিয়ে, ওষুধ ছিটিয়ে, মশারি টানিয়ে মশার উপদ্রব থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করছেন নগরবাসী। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। দিনে বাচ্চাদের মশারি টানিয়ে ঘুম পাড়াতে হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মশক নিধনের আহ্বান জানিয়ে এলাকাবাসী কাউন্সিলর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানালেও কোনো প্রতিকার মিলছে না বলে জানা গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা ইনকিলাবকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার উপদ্রব কিছুটা বেড়ে যায়। যে কারণে আমরা ইতোমধ্যে মশা নিধনের জন্য জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রামসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশনের নিয়োজিত কর্মী ছাড়াও প্রতিটি ওয়ার্ডে আউটসোর্সিং এর ভিত্তিতে আমরা ৪/৫ জন কর্মী আতিরিক্ত নিয়োজিত করেছি। এরা প্রতিদিন সকাল ও বিকাল দুই দফায় ওষুধ ছিটানোর কাজ করছে। তিনি বলেন, আগামী শনিবার থেকে মশা নিধনের জন্য একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের শুরু করতে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের দাবি, বাসাবাড়ির আঙিনা, ফুলের টব, ছাদের বাগান, ভবনের চৌবাচ্চা, এসি-ফ্রিজ থেকে জমা পানিতে মশার বংশ বিস্তার ঘটছে বেশি। ওই সব স্থানে মশক কর্মীরা যেতে পারে না। কর্মীরা নিয়মিত ও সঠিকভাবে মশক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। নগরবাসী সচেতন হলে এ কাজ অনেক সহজ হবে বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেন্ডি ডেন্টাল কলেজ এবং আশপাশের এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয় না বলে ওই এলাকার লোকজন অভিযোগ করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, এ এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মীদের কখনও ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না। স¤প্রতি মশার উপদ্রব এতই বেড়েছে, বাসায় অবস্থান করাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আমার ওয়ার্ডে মশার ওষধু ছিটানোর জন্য মাত্র দুটি মেশিন রয়েছে। এ দুটি মেশিন দিয়ে সব এলাকায় ওষধু ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। কেননা আমার ওয়ার্ডটি অনেক বড়।
মশক নিধন খাতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ রেখেছে ৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিনসিসি) ৪৩ কোটি ৩০ লাখ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৯ কোটি ৩০ টাকা।
দুই সিটিতে মশক নিধনে জনবলের সঠিক ব্যবহার এবং সরঞ্জামাদির উন্নয়নে সংস্থার কোনো উদ্যোগ নেই। বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হলেও মশক নিধন কাজের বেহাল অবস্থা। মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে, চাহিদার আলোকে মশক নিধন কাজ করার জন্য সরঞ্জামাদির মারাত্মক সঙ্কট রয়েছে। এরপরও সেসব খাতে ব্যয় করা হচ্ছে না অর্থ।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের ১০ মে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, (উত্তর) বেরাইদ, বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও ডুমনি এবং (দক্ষিণ) শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা, দনিয়া, সারুলিয়া, দক্ষিণগাঁও, নাসিরাবাদ ও মান্ডা এলাকায় এখন পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার কাজ শুরুই হয়নি। ওই এলাকার বাসিন্দারা মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ থাকলেও সেদিকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনো দৃষ্টি নেই।
সংশিষ্টরা জানান, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে কচুরিপানা পরিষ্কার, মশার ওষুধ, সরঞ্জামাদি কেনাসহ প্রভৃতি কাজে ৬০-৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। প্রতিবছর এসব বরাদ্দের সিংহভাগ খরচ হচ্ছে। কোনো বছর বেশিও খরচ হচ্ছে। এরপরও সেবা বলতে কিছুই পান না নগরবাসী। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। জীবনও হারাচ্ছেন অনেকে। আর শুষ্ক মৌসুমে কয়েল, মশার স্প্রেতেও এর উপদ্রব থেকে নিস্তার মিলছে না। নগরবাসীর প্রশ্ন, এত ভোগান্তির শিকার হচ্ছি আমরা, তাহলে অর্থ খরচের ফল কী?
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজধানীতে মশার উপদ্রব ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে। বাসা-বাড়ি তো বটেই, বিমানও রেহাই পায় না মশার উৎপাত থেকে। জনবল সঙ্কট ও যন্ত্রপাতির অভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সিটি কর্পোরেশনও। মশার বংশবিস্তারের মৌসুম শুরু হওয়ায় নগরবাসী দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন মশা নিধন কার্যক্রম শিথিল হওয়ার প্রশ্নে বলেন, কার্যক্রম শিথিল হয়নি, এখনো প্রতিদিনই কাজ চলছে। তবে অভিযানে কিছুটা ধীরগতি এসেছে। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শরীফ আহম্মেদ বলেন, গত আগস্ট, সেপ্টেম্বরে যেভাবে বহুমুখী অভিযান কিংবা সচেতনতা কার্যক্রম দৃশ্যমান ছিল সেটা কিছুটা শিথিল হয়েছে। তবে মশা নিধনে ওষুধ প্রয়োগ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো মূল যে কাজ, সেগুলো নিয়মিতভাবেই চলছে। আমাদের কীটনাশকও এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর নাগরিক সেবা বাড়ানোর অঙ্গীকার করে বর্তমান সরকার অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগ করে। একাংশের নাম দেয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, অপরাংশের নাম দেয়া হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। সংস্থার উচ্চপর্যায়ে কিছু পদ বাড়লেও সেবার মান অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এরপর ২০১৬ সালের ১০ মে ঢাকার পার্শ্ববর্তী ১৬টি ইউনিয়নকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে দুই বছর অতিবাহিত হলেও ওইসব এলাকায় মশক নিধনসহ কোনো নাগরিক সেবা দেয়া হচ্ছে না। তবে স¤প্রতি দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রকল্পের আওতায় সড়ক, ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন