দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে প্রায় ২০ জনের প্রাণ। আহত-নিহত মিলে বছরে সড়ক দুর্ঘটনার ভুক্তভোগীর সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষ। সড়কে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও যানজটে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় লক্ষকোটি কোটি টাকা। এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দেশি-বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবছরই নানা তথ্য উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উঠে আসছে। সেখানে দুর্ঘটনার কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সংখ্যা এবং এসব থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে তথ্য-উপাত্ত ও সুপারিশমালা থাকে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে অদক্ষ ও অযোগ্য চালক এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এ ক্ষেত্রে কারো দ্বিমত নেই। তবে গাড়ির ফিটনেস সনদ নিয়ে ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ি নজর থাকলেও রাস্তায় ফিটিনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধের চেয়ে সনদ বিতরণই যেন তাদের মূল লক্ষ্য। গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স বিহীন চালকদের নিবৃত্ত করতে আইনে পরিবর্তন আনা হলেও আইনের সঠিক বাস্তবায়ন লঙ্ঘিত হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। সড়কের শৃঙ্খলা ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মূলে রয়েছে শরিষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভূত। বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট দালালচক্রনির্ভর কর্মকর্তারাই ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অদক্ষ-অযোগ্য চালককে ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে রাস্তার যানবাহনগুলোকে যন্ত্রদানবে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করছে।
সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে দেশের মানুষ বরাবরই বিক্ষুব্ধ। দুই বছর আগে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে হত্যা করে বাসচালক। এ নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসে এক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করে। সড়ক নিরাপত্তার জন্য শিক্ষার্থীদের সে সব দাবির সাথে দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিগুলো মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। সে প্রেক্ষাপটে দেশের সড়ক পরিবহন আইনে পরিবর্তন নিয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৯ পাস হয়। তবে আইন পাস হলেও তা এখনো বাস্তবায়স হয়নি। অতএব ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। আইনে কথিত অসঙ্গতি নিয়ে বেশ জোরালো প্রতিবাদী ভূমিকায় সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে পুরো পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রাখার বেশ কিছু উদাহরণ দেখেছে দেশের মানুষ। সড়ক পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণকারী মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের দেখা গেলেও তারা সরকারের নীতি ও প্রতিশ্রুতি বা জননিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা করছে না। এমনকি বিআরটিএ’র ফিটনেস ও লাইসেন্সিং অথরিটির বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসগুলোকেও সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করছে বলে জানা যায়।
গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে গাড়ির ফিটনেস সনদ নিয়ে লুকোচুরি, অস্বচ্ছতা ও জাল-জালিয়াতির সবিস্তার চিত্র উঠে আসে। বিআরটিএ’র ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছেই রাজধানীতে বৈধ-অবৈধ ঠিক কত সংখ্যক গাড়ি চলাচল করছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। লাখ লাখ গাড়ির কোনো ফিটনেস সনদও নেই। যেসব গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে, বিশেষত গণপরিবহনের শতকরা ১০ ভাগও প্রয়োজনীয় তদারকি, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেয়া হয় না। এর মানে হচ্ছে, ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া গাড়ির অধিকাংশই ফিটনেস পাওয়ার শর্ত পূরণ ছাড়াই ফিটনেস সনদ পাচ্ছে। রাজপথে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর ট্রাফিক আইনের কড়াকড়ি আরোপের সময় মিরপুর বিআরটিএ অফিস থেকে প্রতিদিন সহস্রাধিক গাড়িকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছিল। বলা বাহুল্য, ন্যূনতম যাচাই-বাছাই বা চোখের দেখা ছাড়াই বাড়তি টাকা নিয়ে এসব গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিআরটিএর তরফ থেকে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবের কথা বলা হলেও নেপথ্যের কারণ হচ্ছে সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট দালাল চক্রের সিন্ডিকেটেড বাণিজ্য। সারাদেশে ৪৩ লাখ মোটরযানের বিপরীতে মোটরযান পরিদর্শকের সংখ্যা মাত্র ১২৫ জন। তবে এখন যেভাবে গাড়ির ফিটনেস দেয়া হচ্ছে, তাতে মোটরযান পরিদর্শকের প্রয়োজন পড়ে না। আনসিন গাড়ির ভূয়া কাগজপত্রের উপর ফিটনেস সনদ দিয়ে সড়ক মহাসড়ককে মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত করা হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি বিআরটিএ’র জনবল কাঠামো, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই হোক অগ্রাধিকার পদক্ষেপ। ফিটনেস পাওয়ার যোগ্য গাড়ি যেন কোনো বিড়ম্বনা বা বাড়তি খরচ ছাড়াই ফিটনেস সনদ পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিআরটিএ’কে দলীয় ক্যাডার ও দালালমুক্ত করে ত্রু টিযুক্ত-ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ির ভূয়া ফিটনেস সার্টিফিকেট বিতরণ বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আপসহীন ভূমিকা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন