শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

পশুপাখি প্রকৃতির অলঙ্কার

প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : বন্যপ্রাণী,পশুপাখি আল্লাহর অপার নিয়ামত, বন-জঙ্গল-প্রকৃতির অপরূপ অলঙ্কার। এককালে শহর-বন্দর-গ্রামে গাছগাছালি ছিল। পাখপাখালির কলতান, সুমধুর গান ছিল। তখন ব্যাপক হারে নির্দয়ভাবে পশুপাখি হত্যা করা হত না। মানুষ ও বন্য পশুপাখিদের মধ্যে মিত্রতা ও সখ্য ছিল। একদা গ্রামাঞ্জলে ভোদর, মেছোবাঘ, মুছবিলাই, টলা, খাটাস, কুকুয়া, পেঁচা, বাঁদুড় ইত্যাদি দেখা যেত। এসব পশুপাখি বন্য হলেও মানুষ এদের পোষা প্রাণীর মত মমতা করত। হত্যা করত না। তখন বাসাবাড়ি-বনজঙ্গলে প্রচুর বৃক্ষ ছিল। এসব গাছগাছালিতে ফলমুল থাকার কারণে পশুপাখি ফল-ফসল খেত। হাল আমলে অবাধে বৃক্ষ নিধন এবং প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণ না করার কারণে পশুপাখিদের জীবন হুমকির সম্মুখীন। জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে বন ও পশুপাখি অপরিহার্য। হাল আমলে এয়ার গানের অবাধ ব্যবহার এবং শৌখিন পাখি শিকারিদের যত্রতত্র পাখি শিকারের কারণে পাখপাখালির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
বনজঙ্গল নিধন এবং খাদ্যাভাবে বন্য পশুপাখি জীবনধারণের জন্য ঝুঁকি নিয়ে আহার গ্রহণের জন্য বাসাবাড়িতে হানা দিচ্ছে। দুর্বলতা ও অপুষ্টির কারণে এরা ধরা পড়ছে। কোথাও কোথাও একশ্রেণীর শৌখিন পাখি শিকারি নির্মমভাবে এদের মারছে। সাম্প্রতিককালে বন বিভাগ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, বার্ডস ক্লাব, এনজিও এবং সর্বোপরি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতি ও পশুপাখির প্রতি মানুষের মায়ামমতা বাড়ছে। ধৃত ও আহত পশুপাখি উদ্ধার করে সেবাশুশ্রƒষা দিয়ে প্রকৃতির কোলে ফের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আমার মুসলিম কোয়ার্টারস্থ পৈতৃক বাসগৃহ রসুলপুর হাউস একটি মিনি জঙ্গল ও মিনি চিড়িয়াখানা। ছুন্নতে রাসূলুল্লাহ হিসেবে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ আন্দোলনের একজন সামান্য কর্মী। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি শহীদ মিনার, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বৃক্ষরোপণ করি। আমার বাসগৃহে ইউকেলিপিটাস, অর্জুন, করমচা, মাল্টা থেকে শুরু করে নানা প্রজাতির বৃক্ষ আছে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেটের বিশিষ্ট কলামিস্ট-গবেষক প্রকৃতিপ্রেমী বন্ধুবর আফতাব চৌধুরী আমার প্রেরণার উৎস। সুলেখক ও ভাগ্যবান আফতাব জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণে পুরস্কৃত হয়েছেন। আমার একমাত্র নাতির কারণে আমার বাসা একটি মিনি চিড়িয়াখানা। কবুতর-কোয়েল-টিয়া-ময়না-ঘুঘু, তিতির থেকে শুরু করে হরেক রকম দেশী পাখি আছে আমার সংগ্রহশালায়। এখন সে বড় ও বুঝদার হয়ে গেছে বলে তাকে আর শুধুমাত্র পাখির ছবি ও খেলনা দিয়ে বুঝ দেয়া যায় না, জীবন্ত পশুপাখিই এনে দিতে হয়। শ্রীমঙ্গলস্থ বন্যপ্রাণী প্রেমিক, একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার মালিক বাবু সিতেশচন্দ্র দেব ধৃত ও অসুস্থ বন্যপ্রাণীকে যেভাবে সুস্থ করে বন বিভাগের সহায়তায় উন্মুক্ত করেন আমি এক্ষেত্রে তারও অনুসারি বটে।
আমার মিনি চিড়িয়াখানায় সকাল-সন্ধ্যা নিজ হাতে খাবার বিতরণ করি। প্রত্যহ ঘুম থেকে উঠে নিজে দানাপানি গ্রহণের পূর্বে পাখিগুলোকে আমি খেতে দেই। আবার বিতরণের সময় কিছু বাড়তি খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যায়। প্রত্যহ সকাল-বিকাল খাঁচার আশপাশ ও আঙ্গীনায় শালিক, বুলবুলি, কেচকেচি, চড়ই পাখি এসে খাবার খেয়ে যায়। একদিন একটি ডাহুক পাখিও দেখেছি। এই পক্ষিকুলের শুভাগমন ও আহার গ্রহণে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে প্রত্যহ আমার আঙ্গীনায় আমি নিজ হাতে ধান-চাল-গম-রুটি ছিটিয়ে দেই। আমার বাসগৃহের বৃক্ষরাজি এবং এসব বাড়তি খাবারের লোভে দিনে ভুবনচিল এবং রাতেরবেলা টলা-মুছবিলাইও হানা দেয়। আমার খাঁচা ভেঙ্গে কবুতর-ঘুঘুও মাঝে মধ্যে সাবাড় করে। আমার নিকট প্রতিবেশী এডভোকেট বদরুল ইসলামের চেম্বার ও বাসায় নৈশ অভিযান চালিয়ে মুরগির ঘাড় মটকিয়ে রক্তপান করে। এ ব্যাপারে আমি বন বিভাগের সাহায্য ও পরামর্শ চাইলে বন বিভাগের এই জাতীয় ফাঁদ নেই বলে জানান। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ সিতেশ দা আমাকে একটি জরুরি পরামর্শ দিলেন। শিশুদের এই জাতীয় মুছবিলাই থেকে দূরে রাখতে বললেন। ক্ষুধার্ত এই প্রাণী শিশুদের আক্রমণ করতে পারে। প্রমাণও আছে।
কিছুদিন আগে একটি দুর্লভ ভুবনচিল আমার মুরগি এবং তিতির দম্পতিকে ছো মেরে ধরে নিয়ে যাবার জন্য আক্রমণ চালায়। ক্ষুধাতুর দুর্বল ভুবনচিল উল্টা আমার ডাউস সাইজের মোরগের আক্রমণে ধরাশায়ী হয়, প্রাণভয়ে চি চি আওয়াজ করতে থাকে। আমি চিলটিকে হত্যা না করে ছেড়ে দেই। সেদিন শ্রীমঙ্গলে ছিল সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। প্রচ- শীতে রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এই বয়সেও আমি অফিসে পানচুয়েল। সকাল ৯টার মধ্যেই কোর্টে যাই। সাতসকালে উঠে পক্ষীকুল দেখতে গিয়ে দেখি পাখি ও খাবার খেতে এসে নিজেই কাহিল হয়ে শীতে ককাচ্ছে একটি বিশাল পাখি। চিনতে ভুল করলাম না। বিরল প্রজাতির লক্ষী পেঁচা বসে আছে। ওড়ার শক্তি নেই। পাখিটিকে উদ্ধার করে সঙ্গে করেই জেলাবারে নিয়ে এলাম। সাংবাদিক ও কলিগদের মধ্যে উল্লাস দেখা গেল। সিতেশ দাকে ফোন করলাম পাখিটাকে নিয়ে যেতে তার ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় সংগ্রহের জন্য। দাদা বললেন, এটা বিরল প্রজাতির, বন বিভাগ পাওয়ার হকদার। তিনিই আমার বরাত দিয়ে ডিএফও সাহেবের অফিসে ফোন দিলেন। দ্রুতগতিতে একজন ফরেস্ট রেঞ্জার পাখিটি সংগ্রহ করতে এলেন। ইতিমধ্যে স্থানীয় বন্ধুগণ অনেকেই এসে ছবি ও আমার সাক্ষাৎকার নিলেন।
লক্ষী পেঁচাকে আমি বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করলাম। রেঞ্জার সাহেব আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন। একটি বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী প্রাণে রক্ষা পেল। তাই বলি, বনের অলঙ্কার বনের প্রাণী মারবেন না, ধরবেন না, এদের বাঁচাতে দিন।
লেখক: ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। সেক্রেটারি, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিওর এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন