পূর্ব প্রকাশিতের পর
আর এরই ধারাবাহিকতায় বাঙ্গালী ধীরে ধীরে তার অধিকার অর্জনের সংগ্রামে এগিয়ে যেতে থাকে এবং পরবর্তীতে রক্তার্জিত স্বাধীনতার পেক্ষাপটে অভ্যুদয় ঘটে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারী বাঙ্গালীর জাতীর জীবনে উদ্দীপ্ত চেতনায় প্রতীক। আর এ চেতনা ও বোধের ব্যাপ্তি বর্তমানে শুধু আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারী সমগ্র বিশ্বব্যাপী “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই কানাডার বসবাসকারী বাংলাদেশী সহ জনাব রফিকুল ইসলাম ও তার সহযোগী আবদুস সালাম, মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড নামে একটি সমিতি গঠন করেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে “আন্তর্জাকিত ভাষা দিবস” ঘোষণার প্রস্তাব দিয়ে একটি পত্র পাঠান। পরে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইউনেস্কোর সাথে সমিতির পক্ষ থেকে ১০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত সাতটি ভাষার একটি আবেদন পত্র পাঠালে ইউনেস্কোর শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়া সমিতিকে জানান বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয়, তবে যদি কোন সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে বিবেচনা করা হবে। অতঃপত তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ,এস,এইস,কে ছাদেক ও সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় এবং ইউনেস্কোর কাছে যথাযথভাবে প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবটি বিশ্বের ২৭টি দেশ সমর্থন করে এবং ইউনেস্কোর অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। ইউনেস্কোর গৃহীত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলা হয় “সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার” মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র ও বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না। তা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহনশীলতা ও সংলাপের উপর ভিত্তি করে বিশ্বে সংহতি আরো জোরদার হবে। প্রস্তাবে আরো বলা হয়, মাতৃভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলো এবং ইউনেস্কো সদর দফতরে নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হয়। বিশ্ব সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারীর এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য একটি গভীর গর্বের বিষয়। বিশ্বের (জাতিসংঘের) ১৯০ টি দেশ নতুন শতাব্দীতে নতুন মাত্রায় নিজ নিজ রাষ্ট্রে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারীতে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” পালন করছে। এ জন্য ইউনেস্কো ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। কারণ এ সংস্থার মূল লক্ষ হল জাতিতে জাতিতে শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা সু-নিশ্চিত করা। আমরা পূন্য লাভের জন্য যেমন কোরআন ও হাদিস শরীফ পড়বো, তেমনি ইসলাম যে একটি মানবতাবাদী ধর্ম, বিজ্ঞান ও যুুক্তিভিত্তিক ধর্ম, একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান এবং এর আদেশ ও নিষেধ জানার জন্য বাংলায় এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা অধ্যয়ন করবো। কারণ কোরআন ও হাদীস শরীফে কোরআনকে বুঝে পড়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। আর কোরআন বুঝে পড়তে হলে ও মনের ভাব প্রকাশ করতে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। বাংলা ভাষাভাষী প্রত্যেকটি মুসলমান যখন মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে কোরআন ও হাদীস শরীফ বুঝে পড়তে সক্ষম হবে। কেবল তখনই তারা ইসলামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবে।
দুঃখের বিষয় আজ আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরা অবজ্ঞা করে চলছি। চারদিকে আজ পশ্চিমা এবং হিন্দির আগ্রাসন। তরুন সমাজ পশ্চিমা অশ্লীল সংস্কৃতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে ভাষার ব্যবহার করার কথা থাকলেও আজ সিংহ ভাগ জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। সরকারি বিভিন্ন পদ ও বিচারিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করে ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজিকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বাংলাকে ইংরেজি এবং হিন্দির সঙ্গে মিলিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে এ জাতির বীর সন্তানরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিল, সে মাতৃভাষা বাংলাকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ভাল লক্ষণ নয়। আমাদের সবাইকে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে আরো সচেতন যত্নশীল হতে হবে।
যে কোন সমাজের ঐতিহ্য, মেধা এবং সংস্কৃতিক বিকাশ ও লালনে ভাষা এক সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। অথচ অযত্ম ও অবহেলায় বহু ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এবং বহু ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। ইউনেস্কোর এ ঘোষনা শুধু “অমর একুশের” স্বীকৃতি নয় বরং পুরো পৃথিবীর সব জাতির মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্তে অনেক ভাষা রক্ষা পাবে এবং বৃদ্ধি পাবে মাতৃভাষার মর্যাদা। মাতৃভাষার লালন ও বিকাশের মাধ্যমেই মানব জীবনের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব, যা পক্ষান্তরে দেশ, সমাজ ও বিশ্বের জন্য সামগ্রিক কল্যাণই বয়ে আনবে। এই মুর্হুতে দেশের বিজ্ঞ ইসলামী জ্ঞানে সু-পন্ডিত বিদগ্ধ লেখক সৃষ্টি করে সুস্থ্য সাহিত্য নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম সমাজকে । যারা নবীর উত্তরসূরি তাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকার সময় নেই। আসুন, প্রাণের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করি এবং ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করে আগামী প্রজন্মের জন্য অবদান রেখে যাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন