নদীর নাম মধুমতি। সেই নদীর পাশের গ্রাম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিনটি ছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আজ অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন।
নিপীড়িত মানুষের মুক্তিদূত এর্নেস্তো চে গুয়েভারা ও ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো বন্ধুদ্বয়কে বলা হয় সারাবিশ্বের নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অসহায় মানুষের মুক্তিদাতাদের আইডল। দুনিয়াজোড়া এই দুই খ্যাতিমানের একজন ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ (আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসী এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম)’।
ফিদেল কাস্ত্রো’র চোখে হিমালয় পর্বতের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচি ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয় অনেক আগেই। ১৭ মার্চ জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে ক্ষণগণতা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি থেকে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, পাকিস্তানীদের গোলাম হয়েই থাকতে হতো। এ জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ ‘জাতীয় শিশু দিবস’ পালিত হয়। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এবার কর্মসূচি সংকুচিত করে আনা হয়েছে।
১৭৫৭ সালে মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশির প্রান্তরে ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার পরাজয়ের পর বাংলার আকাশে নেমে আসে অন্ধকার; হারিয়ে যায় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব। ইংরেজরা দেশ শাসনের নামে ১৯০ বছর উপমহাদেশের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশকে দুই ভাগ করে উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলেও বাংলাদেশের মানুষ (পূর্ব পাকিস্তান) পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের (পিন্ডির শৃঙ্খল) নিপীড়নের শিকার হতে থাকেন।
অসীম সাহসিকতার সঙ্গে আজীবন সংগ্রামী নেতা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ২৩ বছর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধ থেকে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চে দৃঢ়কষ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উদ্দেশে দেয়া ভাষণ কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’।
পৃথিবীতে বহু ক্ষণজন্মা মানুষ জন্ম নিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো আত্মবিশ্বাসী নেতা বিরল। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন; তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আদর্শ, একটি দর্শন। তাঁকে নিয়ে দেশ ও জাতি যতটুকু গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ততটুকু হয়নি। তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইগুলো পড়তে পড়তে ছড়িয়ে রয়েছে হিমালয়ের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটির জীবন সংগ্রামের কাহিনী।
গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামে ‘খোকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেই খোকা রাজনৈতিক দৃঢ়তায় দেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস আর বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার ওপর ভর করে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ১৮ বছর বয়সে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি নিজের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার চিত্র এভাবে তুলে ধরেন। ‘১৯৩৮ সালে শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) গোপালগঞ্জে আসেন। তখন তার সমাবেশে ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করি। তিনি কলকাতা গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই। শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক আমাদের ছাত্রনেতা ছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ করে গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগ গঠন করব। খন্দকার শামস্দ্দুীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন মুসলিম ছাত্রলীগের আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগও গঠন করা হলো। ...মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হলো। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হয়। আস্তে আস্তে আমি রাজনীতিতে প্রবেশ করলাম’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা-১৪)।
তবে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করায় শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে প্রথম কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবনের যাত্রাপথ।
বঙ্গবন্ধুর কার্যত শিশুকাল থেকেই ছিলেন ডানপিটে ও একরোখা স্বভাবের; ভয়ভীতি বলে তার আদৌ কিছু ছিল না। তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি এমন অসংখ্য ঘটনা তুলে ধরেছেন। হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘাত-সংঘর্ষের পর তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রমাণ দেয় তিনি ওই সময়ে মুসলিম সমাজের জন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা, দৃঢ়-বলিষ্ঠতার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শেখ মুজিবুর রহমান ডাকসাইটে হওয়ায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা তাঁকে প্রশ্রয় দেন, কাছে টেনে নেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য-উচিত কথা বলার জন্য শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে হয়ে উঠেন ‘মুজিব ভাই’।
স্কুলেই তার মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। ছাত্র জীবনেই দুস্থ-গরিব-আর্তদের সেবা করার মধ্য দিয়ে নিপীড়িত বিপন্ন মানুষের প্রতি তার মহানুভবতা, মানবতার আদর্শ ফুটে উঠে। স্কুল জীবনে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দরদ থেকে মানুষের বিপদে-আপদে অকুণ্ঠভাবে সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর জীবনের অনুপম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। তবে রাজনীতিক হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আই.এ. পড়ার সময় থেকে। সেই সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে থেকে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
উপনিবেশিক শাসনামলে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, হাঙ্গামা, দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো, নিজের লেখাপড়ার চিত্র তিনি শিল্পীর তুলির মতোই বইতে লিখেছেন। ছোটবেলায় অবহেলিত নির্যাতিত মুসলমানদের যাতনা তাকে নাড়া দিত।
তিনি লিখেছেন, ‘ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করছিল। মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহি চাকরি থেকে বিতাড়িত হন। মুসলমানদের স্থানে হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করছিল ইংরেজরা। মুসলমানরা কিছুদিন আগে দেশ শাসন (সিরাজ উদ দৌল্লা) করেছে তাই ইংরেজদের মেনে নিতে পারেননি। সুযোগ পেলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদরা। বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষে পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরীক হয়েছিল।
তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীতুল্লাহর ফরায়জি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ করতাম। এর কারণও ছিল। এক সাথে লেখাপড়া করতাম, একসাথে বল খেলতাম, এক সাথে বেড়াতাম। বন্ধুত্ব ছিল হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সম্মান পেত হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি যখন কোনো হিন্দু বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম আমাকে তাদের ঘরের মধ্যে নিতে সাহস করতো না আমার সহপাঠিরা (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা-২২-২৩)’।
একদিকে নির্যাতিত মুসলমানদের অধিকার আদায়ের দৃঢ়তা; অন্যদিকে সোহ্রাওয়ার্দীর সান্নিধ্য পাওয়া তরুণ মুজিবকে ‘মানবতার রাজনীতিক’ হওয়ার প্রেরণা জোগায়। নাড়িপোতা মধুমতী তীরের জনপদ, টুঙ্গিপাড়ার প্রাকৃতি, সাধারণ মানুষের প্রতি হৃদয়ের টান, ছাত্র জীবনে খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ, দরিদ্র মানুষের প্রতি হৃদয়নিংরানো ভালোবাসা এবং স্বচক্ষে দেখা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তরুণ রাজনীতিক মুজিবের মনকে আন্দোলিত করে। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রদের মধ্যে ‘জনপ্রিয় নেতা’ হয়ে উঠেন। ইংরেজদের মুসলমানদের ওপর জুলুম নির্যাতন এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণপদে হিন্দুদের বসানোর চিত্র তাকে প্রতিবাদী করে তোলে। এর মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গোপালগঞ্জের আনাচে-কানাচে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছার মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে একটি রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি তৈরি হয়। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিষ্ঠা, ত্যাগ, আন্তরিকতা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেন তৎকালীন পর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) অবিসংবাদিত নেতা।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরের বছর ১৯৪৮ সালে গঠন করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ আত্মপ্রকাশ করলে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ, পাকিস্তানের সামরিক শাসনে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগকে গণমানুষের রাজনৈতিক দলে পরিণত করার নেপথ্যে ছিল শেখ মুজিবের অসামান্য অবদান। ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ঘোষণা, আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক।
জুলফিক্কার আলী ভুট্টোর গোয়াতুর্মিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তান শাসকের তালবাহনায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নতুন ইতিহাস রচিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বেই ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে।
বঙ্গবন্ধু কার্যত সক্রিয় রাজনীতি করেন ৩৭ বছর। তাঁর রাজনীতিজুড়ে ছিল হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ছায়া। এ ছাড়াও শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের জীবন সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির চেতনার উন্মেষ ঘটে।
ইতিহাসের পাতায় বিশ্বের বরেণ্য রাজনীতিক, দার্শনিকদের সারিতে জায়গা করে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, প্লেটো, মেকিয়াভেলি, সক্রেটিস, এরিস্টোটোলসহ অনেক দার্শনিকের রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে তাদের চেয়েও বেশি প্রসঙ্গিক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন। কারণ বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল মানবতাবাদ। তাঁর বইগুলো পড়লে দেখা যায় জীবনচরিত্রে ছাত্র জীবন থেকেই মানবতার আদর্শ ফুটে উঠেছে।
রাজনৈতিক দলের অফিসের টেবিলে ঘুমানো, টাকার অভাবে না খেয়ে ট্রেনে ২৪ ঘণ্টা জার্নি, পত্রিকায় ও ইন্সুরেন্সে কাজ করে সামান্য অর্থ সংগ্রহ এগুলো এখনকার মুজিবপ্রেমীদের জন্য অনুসরণীয় অনুকরণীয়। সমাজের অবহেলিত বঞ্ছিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দলমত নির্বিশেষে দরিদ্রদের সহায়তা করা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিরসনে নিরলস প্রচেষ্টা এবং এদেশে মানুষের ওপর অগাধ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে মানবতার আদর্শ ফুটে উঠে।
তার মতো আত্মবিশ্বাসী নেতা পৃথিবীতে কমই জন্ম নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের কেউ তাকে হত্যা করবে এটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। সে কারণে কোনো সতর্কতাই গ্রাহ্য করেননি।
’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা যখন বন্দুক উঁচিয়ে হত্যায় উদ্যত তখনো তিনি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘তোরা কি চাস’? এমন সাহস দেখানো কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
দলমত নির্বিশেষে তিনি দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন তাই দলের ভেতরে যারা দুর্নীতি করেন তাদের লাগাম টানতে উচ্চস্বরে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি/ আমি পেয়েছি চোরে খনি’, ‘সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ৮ কোটি কম্বল/ আমার কম্বল গেল কই’। এমন উক্তি কেবল দেশমার্তৃকার নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব। তাইতো এখনো কান পাতলেই বাতাসে ভেসে আসে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত/ বঙ্গবন্ধু মরে নাই/ যদি রাজপথে মিছিল হতো/ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই মুক্তি চাই মুক্তি চাই’। সত্যিই বঙ্গবন্ধু মরেননি; তিনি বেঁচে রয়েছেন দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। তাইতো অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন- ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন