বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহান স্বাধীনতা দিবস

জাতির ইতিহাসে মুজিববর্ষ

আহমেদ উল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

যেকোনো জাতির জন্য স্বাধীনতা হলো পরম আরাধ্য ধন। পরাধীনতার শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতিকে উদ্ধারের জন্য যুগে যুগে মহামানবগণের উদয় হয়ে থাকে, তবে সকলের পক্ষে ওই জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারে না। তেমনি বাঙালি জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার চেষ্টা যুগ যুগ ধরে বহুবার ব্যর্থ হলেও, যে মহামানবের অসীম ত্যাগের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে মুক্তির পরমানন্দ, পেয়েছে স্বাধীনতা, পেয়েছে নতুন দেশ, তিনিই বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতো কি না তা বলা মুশকিল। তবে তার দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক কৌশল ও ত্যাগের মধ্যদিয়ে আমরা পেয়েছি স্বর্গীয় স্বাধীনতা, পেয়েছি আমাদের দেশ।
এই মহামানব ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ওই সময়ের ফরিদপুর জেলা, বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে নবারুণের বিস্ময় নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। টুঙ্গিপাড়ার ওই ছোট্ট খোকাই যে একদিন হবে বাঙালির জাতির মুক্তির দিশারী, তার ইঙ্গিত অনুধাবন করেন ওই সময়ের অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে এলে স্কুল ছাত্রদের পক্ষে ভাঙাস্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়া বন্ধকরণের দাবি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। তখন থেকেই তার মস্তিস্কে নেতৃত্বের বীজ অঙ্কুরোদগম হতে শুরু করে।
১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন। চলতি বছরের এই দিনটি জাতির জনকের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০-২০২১ সালকে সরকার মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বর্ণাঢ্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বছরব্যাপী আনন্দ উদযাপন। মুজিব বর্ষ ঘিরে জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য দুটি কমিটি গঠন করে ইতোমধ্যে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
আগামী ১৭ মার্চ মুজিব বর্ষ শুরু হচ্ছে, কেবল বাংলাদেশেই নয় আন্তর্জাতিকভাবে সারা পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হবে মহাসমারোহে! সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র মেয়র মুরিয়েল বোসার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে আগামি ১৭ মার্চ ২০২০ইং থেকে ১৭ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে মুজিববর্ষ ঘোষণাপত্র জারি করেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রবাসীরা নানান কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ১৭ মার্চ প্রথম প্রহরে নিউইয়র্ক টাইমস স্কোয়ারে প্রবাসীদের উদ্যোগে প্রথম অনুষ্ঠান হবে। ২০ মার্চ শিকাগোতে আরেকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন-প্রেষণের অবসান হলেও বাঙালির মুক্তির দুয়ার খুলেনি, বরং বাঙালি জাতির ওপর নেমে আসে- আরেক বর্বরতম অন্ধকার যুগ; নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণ, নিপীড়ন, উৎপীড়ন এবং জাহেলিয়া যুগের অত্যাচার। পাকিস্তানী শাসকমহলের বর্বরোচিত অত্যাচারের নেমির তলে পিষ্ঠ হয়ে অতিষ্ঠ বাঙালি জাতি যখন দিশেহারা, দিগ্ভ্রান্ত, ঠিক তখনই মুক্তির মশাল হাতে নিয়ে নিপিড়ীত মানুষের মুক্তির জন্য নক্ষত্রবৎ দিশারী হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষে বাঙালি জাতি ঝাপিয়ে পড়ে পাকসেনাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। শুরু হয় বাঙালি মুক্তির লড়াই, স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাঙালির তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে বাংলার রাজপথ, সবুজ-শ্যামল পথ-প্রান্তর...
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন ছিল। ওইদিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা শেষে ফিরে আসার পর সাংবাদিকগণ বঙ্গবন্ধুকে তার জন্মদিন সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- এদেশে জন্মদিনই-বা কি, আর মৃত্যুদিনই-বা কি; তবে আমার জনগণই আমার জীবন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকসেনারা বাঙালি নিধনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত গণহত্য, যা কত শত যুগ আগের আরবের আইয়েমে জাহেয়িার বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা ওয়ারলেস মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুরুল আহমেদ চৌধুরীকে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান শাহ্ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী স্বকণ্ঠে প্রচার করেন; এর পরদিন ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে অবস্থিত অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ওই ঘোষণা পুন:প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় করাচীতে। এদিকে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে বাংলার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে! এরই মধ্যে ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে প্রচার করা হয় যে, ১১ আগস্ট থেকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হবে। এই ঘোষণায় সারা পৃথিবীজুড়ে প্রতিবাদ ও উদ্বেগের ঝড় শুরু হয়। ১১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুকে হাজির করা হয় ইয়াহিয়া খানের সামনে, ওই সময়ে ভুট্টো এবং জেনারেল আকবরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইয়াহিয়া খান করমর্দনের জন্য বঙ্গবন্ধুর দিকে হাত বাড়ালে, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ওই হাতে আমার বাঙালির রক্ত লেগে আছে, ওই হাত আমি স্পর্শ করব না।
বাঙালি মা-বোনদের ইজ্জত ও বীর বাঙালির তাজা রক্তের বিনিময়ে নয় মাস অবিরত যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় এবং আমাদের বিজয় অর্জিত হয়; কিন্তু ওই বিজয় ছিল বাঙালির জন্য অপূর্ণ, কেননা, তখন বাঙালির স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে অবরুদ্ধ। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন রাস্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো বাধ্য হয়ে করাচীতে ঘোষণা করেন যে, শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া হবে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু প্রথমে লন্ডন এবং পরে যাত্রাবিরতি শেষে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় আগমণ করেন। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১০ জানুয়ারিই মুজিব বর্ষের ক্ষণ গণনা শুরু, অর্থাৎ মুজিবাব্দের শুভ সূচনা।
১৭ মার্চ সূর্যোদয়ের ক্ষণ থেকেই অনুষ্ঠান উদযাপন শুরু হবে। অনুষ্ঠানের মূল পর্বে বিভিন্ন দেশের সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান, বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন। বিশেষ করে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইউনেস্কোর সাবেক মহাসচিব ইরিনা বুকোভা, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক, আরব লিগের সাবেক মহাসচিব আমর মুসাসহ আরও বহু বিশ্বনেতাগণ উপস্থিত থাকবে বলে আশা করা যায়। আমন্ত্রণের তালিকায় রয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিশেষ করে ভারতের সাবেক রাস্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের কংগ্রেস পার্টির নেতা সোনিয়া গান্ধী, জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জান্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখ।
ভারতীয় উপমহাদেশে অশোকবর্ষের পর আর কোনো বর্ষ নেই, যুক্ত হলো মুজিব বর্ষ। আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, শুনেছি তার বজ্রনিনাদিত গগনবিদারি কণ্ঠ, জেনেছি তার দেশপ্রেম ও অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেবার গল্প। তবুও আমি ধন্য ও গর্বিত এমন এক মহামানব ও মহানেতার দেশে জন্মগ্রহণ করে। আর বিশেষ করে মুজিবাব্দের ঐতিহাসিক সূচনা দেখতে পেরে বাঙালি হিসেবে আমি ধন্য ও গর্বিত। আরো গর্বিত হোক বাঙালি জাতি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন