আমাদের স্বাধীনতা ৪৭ বছর পেরোল। খুব কম সময় নয়। এ সময়টাতে আরো অনেক কাজের সাথে একটি বড় কাজ হয়েছে। সেটা হচ্ছে, স্বাধীনতা কি, সে সম্পর্কে দেশের মানুষ অনেক কিছু জানতে পেরেছে। বস্তুত, দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ স্বাধীনতা শব্দটি ও তার দ্যোতনার সাথে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি পরিচিত। বলা যায়, স্বাধীনতা শব্দটি তার শাব্দিক খোলস ছেড়ে বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ অর্থ নিয়ে দেশের মানুষের খুব নিকটে পৌঁছেছে। বালক ও কিশোর বয়সের কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশের বর্তমান জীবিত মানুষদের মধ্যে অনেকেই দু’টি স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। সবার জানা ব্রিটিশ আমল বা তার আগে স্বাধীনতা দিবস বলে কিছু ছিল না। ১৯৪৮ সাল থেকে উপমহাদেশে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন শুরু হয়। সে হিসেবে বয়সে পুরনোরা তো বটেই, ১৯৭০ সালে যারা ন্যূনতম জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার বয়সে পৌঁছেছিলেন তারা তৎকালীন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের কথা স্মরণ করতে পারেন। একাধিক স্বাধীনতা দিবস পেয়েছে, বিশে^ এমন দেশের সংখ্যা বেশি নয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ সুদান, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি দেশের নাম উল্লেখ করা যায়। এক সময় আমাদের মত আরো অসংখ্য মানুষের প্রথম স্বাধীনতা দিবস ছিল ১৪ আগস্ট। জ্ঞান ও বুদ্ধির স্বল্পতা আর অ-চৌকস গ্রাম্য আবহাওয়ায় বালক আমাদের কাছে স্বাধীনতা দিবসটি ছিল ভারি আনন্দের। কারণ, সেদিন থাকত ছুটি আর স্কুলে হত ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। বাড়িতে শাসনের কড়াকড়িটা কম থাকত। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের মানুষ আর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেনি। তারপর ’৭২ সালের ২৬ মার্চ উদযাপিত হয় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস। সেটি ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রথমবারের মত নিজের করে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন। স্বাধীনতা যে কত প্রিয় ও আনন্দময় হতে পারে, আমার ধারণা, ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ছিল তার প্রমাণ। তার পর থেকে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। ফিকে হতে শুরু করে স্বাধীনতার আনন্দ।
দেশের মানুষ ৪৭ বছরে অনেক কিছু দেখেছে। মানুষ দেখেছে ও দেখছে রক্তভেজা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা কিভাবে অদূরদর্শিতা ও অবহেলায় বিনষ্ট ও লক্ষ্যহীন হয়; কিভাবে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে জাতির গর্বের বদলে একটি দলের ব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়; রাজনৈতিক দলের সদস্যরা ভ্রান্ত আদর্শে কিভাবে মানুষ খুনের উৎসবে মেতে ওঠে; আইন-শৃঙ্খলা কিভাবে ভেঙ্গে পড়ে; দুর্নীতি-স্বজন প্রীতি-দলপ্রীতি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কি নির্লজ্জভাবে গ্রাস করে; দুর্ভিক্ষ কিভাবে সম্বলহীন জনজীবনে হানা দেয়; দেশে গণতন্ত্রের স্বপ্নবৃক্ষ কিভাবে উৎপাটিত হয়ে আছড়ে পড়ে একদলীয় শাসনের পদতলে; জাতির স্থপতি ও তার প্রায় গোটা পরিবার এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কিভাবে অন্যায় হত্যাকাÐের মর্মান্তিক শিকার হন; কিভাবে মøান হয়ে পড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকশিখা; ব্যাপক সংগ্রামের মাধ্যমে কষ্টার্জিত গণতন্ত্র কিভাবে দলীয় শাসনে রূপ নেয়; কিভাবে তরতাজা মানুষগুলো চোখের পলক গুম হয়ে চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়; কিভাবে সরকারের ছত্রছায়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘৃণ্য ঐতিহ্যে পরিণত হয়; মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিভাবে রুদ্ধ হয় ও আটকে ফেলা হয় আইনি অক্টোপাশের কঠিন বন্ধনে; নির্মম দমনে বিরোধী রাজনীতিকে কিভাবে দুঃস্বপ্ন করে তোলা হয়; যে দেশে গণতন্ত্র কবরে শায়িত সে দেশকে বিশে^ গণতন্ত্রের রোল মডেল বলে কিভাবে তীব্র-তুমুল প্রচারণা চালানো হয়; পক্ষে থাকলে মিত্র আর বিপক্ষে গেলেই স্বাধীনতাবিরোধীর তকমা লাগিয়ে দিয়ে জীবন দুঃসহ করে তোলা ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়।
বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে বলে জানা যায়। তার সুফল হিসেবে জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিছু ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, নির্মিত হচ্ছে ব্যয়বহুল মেট্রো রেল, নেয়া হচ্ছে আরো সব উন্নয়ন প্রকল্প, স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ এগিয়ে চলেছে, নতুন আরো বিমান বন্দরের ব্যবস্থা হচ্ছে, সরকারী কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করার জোর চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ সবের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে বিএনপি-জামায়াত বলে চিহ্নিত চাকরিজীবীদের পদোন্নতি বন্ধ, চাকরিচ্যুতি, বদলি, অবসরপ্রাপ্তদের পাওনা দিতে দুঃসহ হয়রানির চলমান ট্র্যাজেডি; লক্ষ লক্ষ বিএনপি নেতা-কর্মীকে মামলার জালে জড়িয়ে দিয়ে সপরিবারে পথে বসানো; ঢাকায় বস্তিবাসীদের অব্যাহত সংখ্যাবৃদ্ধি; বিভিন্ন ব্যাংকের শত শত ও হাজার হাজার, কোটি টাকা আত্মসাৎ -চুরি; বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনা নিয়ে রহস্যময় আচরণ; লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের অসহায় জীবনের করুণ গাথা; একেক সময়ে একেক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে কতিপয় বিবেকহীন অর্থলোভীকে তাÐব চালানোর সুযোগ প্রদান; আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণÑ ফলে সবার জন্য আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ না থাকা, কারাগারগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়া সত্তে¡ও দু’টি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আটকে কোনো বিরতি না দেয়া প্রভৃতি নানা বিষয়।
স্বাধীনতার প্রসঙ্গ যখনি আসে তখনি তার অর্থ ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আমজনতার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে ফেরেÑ স্বাধীনতা মানে কি জনসভায় হত্যাকাÐ চালাতে গ্রেনেড হামলায় লাশের স্তূপ তৈরি? স্বাধীনতা মানে কি লাগামহীন বক্তব্য? স্বাধীনতা মানে কি কেউ সরকারবিরোধী রাজনীতি করতে পারবে না? শাসকদলের পরামর্শ অনুযায়ী রাজনীতি করতে হবে? স্বাধীনতার মানে কি ক্ষমতাসীন দলের নেতার অনুমতি ছাড়া থানায় মামলা নেয়া হবে না? স্বাধীনতা মানে কি বহু লক্ষ টাকা না দিলে চাকরি পাওয়া যাবে না? স্বাধীনতা মানে কি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা? স্বাধীনতা মানে কি প্রতিটি অফিসে প্রতিটি পর্যায়ে দলীয় লোকজনের পুনর্বাসন? স্বাধীনতা মানে কি সারা বাংলাদেশে এক পক্ষীয় প্রচার-প্রচারণা-গুণগান? স্বাধীনতা মানে কি কিছু মানুষের স্মৃতিতে অগুণতি অবকাঠামো-স্থাপনার নামকরণ? স্বাধীনতা এমনিতে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক সংগ্রাম, আন্দোলন ছাড়া স্বাধীনতা আসে না। অনেক সময় তাতেও হয় না, প্রয়োজন পড়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের, ঢেলে দিতে হয় বুকের রক্ত। সর্বস্তরের জনগণের রক্তের সাগরে জন্ম নেয় স্বাধীনতার রক্তকমল। স্বাধীনতাকে যদি মূল্যে গণ্য করা হয় তাহলে বলতে হয়Ñ অনেক মূল্যে কেনা হয় স্বাধীনতা। বহু প্রাণের মূল্যে। প্রাণ কেনা যায় না কোনো মূল্যেই। তাই অমূল্য এ স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ সাফল্যের পথে সর্বশেষ আরেক ধাপ এগিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বেরিয়ে আসে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করা। তারপর সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে। এরপর ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হবে। তার জন্য দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে নিয়ে যেতে হবে এবং মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে পৌঁছতে হবে বলে জানা গেছে। কাজটি কঠিন হবে, তবে অসম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ^ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তাকিহিকো নাকাও। এই আশাবাদে সরকারের সাথে সাথে দেশের আশাবাদী মানুষ আরো উজ্জীবিত হবে। উন্নয়নের এ সুফল হয়ত এক সময় জাতির তৃণমূল পর্যায়েও পৌঁছবে। উল্লেখ করা যায় যে বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন চলছে। যতদূর জানা যায়, তাতে বেকারত্বের হার কমেনি। শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের পরিসংখ্যানে স্নাতক বা তারও উচ্চ ডিগ্রিধারীদের মধ্যে শতকরা ৯ জন বেকার থাকার কথা বলা হয়েছিল। এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। সারাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ বলে সর্বসাম্প্রতিক তথ্যে বলা হয়েছে।
দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বেকারের এ সংখ্যা তেমন কিছু নয় বলে শাসকদের মনে হতেই পারে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষের আশাহত, অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবনে স্বাধীনতা একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়াতেই পারে। স্বাধীনতায় তাদের কর্মসংস্থান হয় না, পেটের ভাত জোটে না, পরিবার প্রতিপালনে সক্ষম করে নাÑ সে স্বাধীনতা শ্রী ও মাধুর্যহীন মনে হয়। এ স্বাধীনতা হৃদয়ে আনন্দের দোলা দেয় না।
স্বাধীনতা পরম সাধনার ফুল। যখন ফোটে চারদিক রূপে-রঙে মাতিয়ে দেয়। প্রাণিত করে মানুষকে। পরাধীনতা থেকে মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত, স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ সকল বাধা অতিক্রম করে, বন্ধন পরিত্যাগ করে। স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতীক্ষা মানুষকে সুভাষ বসু, চে গুয়েভারা, শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলার মত মুক্তির মহানায়ক করে।
কোনো জাতির জীবনে স্বাধীনতা একবারই আসে। সে জাতিকে চিরস্থায়ী পরিচয় দিয়ে যায়। স্বাধীনতা স্ফটিক স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র। স্বাধীনতার সাথে শির সমুন্নত রাখার সম্পর্ক। স্বাধীনতার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি। স্বাধীনতার মধ্যে কোনো হিংস্রতা, নীচতা,কলুষতা-কালিমা-প্রতিহিংসার নেই। এটাই স্বাধীনতার চারিত্র। স্বাধীনতা রক্ষা করার যেমন বিকল্প নেই তেমনি এর চারিত্র অবিকৃত রাখা না হলে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা হয় না।
সাহিত্যিক, অনুবাদক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন