(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিয়ের আকদের পর হজরত আয়েশা (রা.) পিত্রালয়ে ছিলেন দুই বছর তিন মাস মক্কায় এবং হিজরতের পর সাত-আট মাস মদিনায়। মদিনায় পৌঁছার পর বনু হারেস ইবনে ফজরজের মহল্লায় হজরত আয়েশা (রা.) তার মা ও আপনজনদের সাথে অবস্থান করেন। প্রথম হিজরি সালের শাওয়াল মাসে তাঁর রুখসতি হয়। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গৃহে ওঠেন। তখন তাঁর বয়স ৯ বছর। এ সময় থেকেই প্রকৃতপক্ষে হজরত আয়েশা (রা.)-এর লেখাপড়া শুরু হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে সরাসরি শিক্ষালাভ করতে থাকেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে যে নবুওয়াতি ইলম শিক্ষা করেন স্ত্রী হিসেবে তা তাঁরই প্রাপ্য ছিল, যার কোনো তুলনা হয় না। তাছাড়া ইতিহাস ও সাহিত্য তিনি পিতার কাছ থেকেই শিক্ষা পান। সে যুগে আরবদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন শাস্ত্রও তিনি শিক্ষা করেন।
মদিনায় বসবাসের পর হজরত আয়েশা পিত্রালয়ে অবস্থান করছিলেন বলে পূর্বেই বলা হয়েছে। পিত্রালয়ে থাকার সময় প্রথমে হজরত আবু বকর (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হজরত আয়েশা (রা.) পিতার সেবা শুশ্রƒষায় নিয়োজিত থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়ার বরকতে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। অতঃপর খোদ আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রোগ এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, বোখারির বর্ণনা অনুযায়ী মাথার সব চুল পড়ে যায়। সুস্থ হয়ে ওঠার পর হজরত আবু বকর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুরোধ জানান আয়েশা (রা.)-কে তাঁর গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, এই সময় তার নিকট মোহর পরিশোধের টাকা নেই। হজরত আবু বকর (রা.) আরজ করলেন তাঁর অর্থ গ্রহণ করতে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মোহরানার সমুদয় অর্থ হজরত আবু বকর (রা.)-এর কাছ থেকে কর্জ হিসেবে গ্রহণ করে হজরত আয়েশার (রা.) নিকট প্রেরণ করেন। (তবকাত) এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, মোহরানা নারীর অধিকার, অবশ্যই তা পরিশোধ করা স্বামীর কর্তব্য, এটি প্রদানে তালবাহানা করার কোনোই অবকাশ নেই। নারী তা উসুল করার জন্য আইনের আশ্রয় নিতে পারে।
মদিনা ছিল হজরত আয়েশা (রা.)-এর শ্বশুরালয়ের ন্যায়। আনসারের নারীরা হজরত আয়েশা (রা.)-কে নববধূ রূপে নিয়ে যাওয়ার জন্য হজরত আবু বকর (রা.) এর বাসভবনে আগমন করেন। হজরত আয়েশা (রা.) তখন বান্ধবীদের সাথে খেলাধুলা করছিলেন এবং দোলনায় ঝুলছিলেন। মা উম্মে রুমান কন্যাকে ডাক দেন। মায়ের ডাক শুনে আয়েশা (রা.) হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে উপস্থিত হন। মাতার হাত ধরে ঘরের দরজা পর্যন্ত নিয়ে আসেন এবং সেখানে মুখ ধুইয়ে মাথার চুল সাজিয়ে দেন। অতঃপর আনসারের নারীরা সেখানে বসেছিলেন, সেই কক্ষে নিয়ে যান, তারা সবাই দুলহানের প্রতীক্ষা করছিলেন। দুলহান যখন কক্ষে প্রবেশ করেন তখন উপস্থিত মেহমানগণ এই বলে স্বাগত জানানÑ “আলালখাইরি ওয়ালবারকাতি ওয়াআলা খাইরি তায়েরিন।” অর্থাৎ তোমার আগমন কল্যাণ ও বরকতময় এবং শুভ হোক। দুলহানকে সাজানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে রাসূলল্লাহ (সা.) এসে উপস্থিত হন। (বোখারি)
এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আপ্যায়নের জন্য দুলহানের ঘরে এক পেয়ালা দুধ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। হজরত আয়েশা (রা.)-এর এক বান্ধবী আসমা বিনতে ইয়াজিদ বর্ণনা করেন যে, আমি সে সময় উপস্থিত ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) পেয়ালা হতে সামান্য দুধ পান করে পেয়ালা হজরত আয়েশা (রা.)-এর দিকে বাড়িয়ে দেন। তিনি লজ্জাবোধ করতে থাকেন। আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দান ফেরত দেবে না। তিনি অতি লজ্জার সাথে পেয়ালা হাতে নিয়ে সামান্য পান করে রেখে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার বান্ধবীদেরকে দাও। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), আমাদের ক্ষুধা নেই। তিনি বললেন, মিথ্যা বলবে না, মানুষের একেকটি মিথ্যা লেখা হয়। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল)।
উল্লিখিত বিবরণ হতে যে কেউ অনুধাবন করতে পারে যে, হজরত আয়েশা (রা.)-এর নিকাহ মোহর এবং রুখসতি তথা প্রতিটি প্রথা অতি সহজ-সরলভাবে পালিত হয়েছে। কোনো প্রকারের আড়ম্বর প্রদর্শনী, অপচয়, বাহুল্য, জাঁকজমক এবং লৌকিকতার গন্ধও তাতে ছিল না। তাই এ নিকাহের আনুষ্ঠানিকতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এতে ফুটে উঠেছে। প্রথমত, আরবে বিবাহের অনুষ্ঠানে যেসব কুপ্রথা ও বেহুদি রীতিনীতির প্রচলন ছিল, হজরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওইসব বেহুদা কুপ্রথার বিলুপ্তি সাধিত হয়। এ সম্পর্কে একটি প্রথার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আরবে মুখবোলা ভাইয়ের কন্যার সাথে শাদি হতো না। এ জন্য খোলা নামের মহিলা যখন হজরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন তখন তিনি বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করেন, এটি কি জায়েজ? আয়েশা তো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভাতিজি কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আন্তা আখুন ফিল ইসলাম’- আপনি তো কেবল ধর্মীয় ভাই।
আরো একটি প্রথা ছিল এই যে, আরবরা জাহেলি যুগে শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি করত না। অতীত যুগে কোনো এক সময় শাওয়াল মাসে ‘তাউন’ বা মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। এ জন্য তারা শাওয়াল মাসকে অশুভ মনে করত এবং এ মাসে কোনো প্রকারের বৈবাহিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করত না। হজরত আয়েশা (রা.)-এর শাদি ও রুখসতি উভয়ই শাওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি এ কারণেই শাওয়াল মাসে এ ধরনের অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন এবং বলতেন, আমার শাদি ও রুখসতি উভয়ই শাওয়াল মাসে হয়েছে এবং এতদসত্ত্বেও স্বামীর দরবারে আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যবতী আর কে ছিল। (বোখারি ও মুসলিম)
আরবে প্রাচীনকাল থেকে নিয়ম ছিল যে, দুলহানের অগ্রভাগে আগুন জ্বালানো হতো এবং আরো প্রথা ছিল যে, স্বামী তার দুলহানের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ মাহমাল (উটের পিঠের হাওদা) অথবা দুলহান বহনকারী সোয়ারীর মধ্যে করতো। (বোখারি) কুসতুলানীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হজরত আয়েশা (রা.)-এর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এসব প্রথা বাতিল হয়ে যায়।
উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) আল্লাহর এবাদত বন্দেগীর প্রতি এতই আগ্রহী ও উৎসাহী ছিলেন যে, তিনি চাশত ও তাহাজ্জুদের নামাজ পর্যন্ত কাজা করতেন না এবং রমজান মাসে তারাবির নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। এ সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, চাশতের নামাজ তাঁর কখনো বাদ পড়ত না এবং এ সম্পর্কে তিনি বলতেন, আমার পিতাও যদি কবর থেকে উঠে আসেন এবং চাশতের নামাজ পড়তে নিষেধ করেন, আমি তাতে বিরত থাকব না। (মোসনাদে আহমদ)।
একই গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সর্বদা তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পরও তিনি এ নামাজে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, ঘটনাচক্রে কোনো রজনীতে যদি নিদ্রা ভঙ্গ না হতো তিনি সময়মতো উঠতে না পারতেন ভোরে উঠে ফজরের নামাজের পূর্বেই তিনি তাহাজ্জুদ পড়ে নিতেন। এ পর্যায়ে একবার তাঁর ভাতিজা কাসেম সেখানে উপস্থিত হয়ে যান এবং এ অবস্থা দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেনÑ ফুফুজান, আপনি এটি কোন নামাজ পড়লেন? জবাবে বললেন আমি রাতে নামাজ (তাহাজ্জুদ) পড়তে পারিনি এবং এখন তা ছাড়তে পারি না। (দারে কুতনি)
রমজান মাস ব্যতীতও তিনি অধিকাংশ সময় রোজা রাখতেন এবং কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সর্বদা রোজা রাখতেন বলে ইবনে সাদে উল্লেখ আছে। একবার ভীষণ গরমের সময় আরাফা দিবসে তিনি রোজা রেখেছিলেন। গরম ও তাপের তীব্রতা এতই অধিক ছিল যে, মাথায় পানি ছিটা দেওয়া হচ্ছিল। এ অবস্থায় তাঁর ভাই আবদুর রহমান বললেন, এ ভীষণ তাপদাহে রোজা রাখা তেমন জরুরি নয়, ইফতার করে ফেলুন। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জবানে শুনেছি যে, আরাফা দিবসে রোজা রাখলে সারা বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যায়, তাই আমি রোজা ভঙ্গ করব ন। (মোসনাদে আহমদ)
উম্মুল মোমেনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর দানশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের এক প্রধান দিক। তিনি অকাতরে দান করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর গৃহে যা কিছু থাকত সবই দান করে দিতেন, কোনো ভিক্ষুককে খালি হাতে ফিরাতেন না সামান্য যা কিছু থাকত তা দান করে দিতেন, এমন কি রোজা পালনরত অবস্থায় কি দিয়ে ইফতার করতেন সে খেয়াল থাকত না। এ সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা উল্লেখযোগ্য। হজরত আমীর মোয়াবিয়া (র.) তাঁর নিকট এক লাখ দেরহাম প্রেরণ করেছিলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদয় অর্থদান করে দেন, একটি পয়সাও তার কাছে রাখেননি, অভাবী দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। ঘটনা চক্রে সেদিন তিনি রোজা রেখে ছিলেন। তাঁর দাসী আরজ করলো, ইফতার সামগ্রীর জন্য কিছু রাখলেই হতো। তিনি বললেন আগে তুমি স্মরণ করে দিতে। (হাকেমের মোস্তাদবেক)।
উম্মুল মোমেনিনের দান-খয়রাতের উৎসাহব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলো। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব এবং শ্রেষ্ঠ নবীকে জীবন সঙ্গী হিসেবে হারানোর পর হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর একাকী জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটেনি। তিনি অভুক্ত থেকেছেন, যা কিছু ছিল সবই গরিব-দুঃখী, অসহায়দের মধ্যে দান করে দিয়েছেন এবং পার্থিব কষ্টের জীবন অবলম্বন করে পরকালীন, উত্তম জীবনকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন, অথচ ইচ্ছা করলেই তিনি রাজকীয় জীবনযাপন করার সামর্থ্য রাখতেন।
হায়াতুন্নবীতে উম্মুল মোমেনিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-সহ যে কষ্টের জীবনযাপন করেছেন, সে সম্পর্কে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও তিনি ব্যক্ত করেছেন। শ্রেষ্ঠ নবীর অতি আদরের স্ত্রী হয়েও তিনি বিলাসী জীবনযাপনের কথা কখনো চিন্তা করেননি। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তুষ্টি অর্জনে তিনি নিজের আনন্দ আয়াশের সব কিছুই বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি কারো এহসান বা উপকার গ্রহণ করতেন না। গ্রহণ করলেও তার বিনিময় পরিশোধ করে দিতেন, এমনকি সোনার অলংকার দান হিসেবে এলেও সেটার প্রতি তার কোনো আসক্তি থাকত না। এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, ইরাকের বিজয় মালার গনিমতের মালের মধ্যে মুক্তার একটি ডিব্বা আসে। সাধারণ মুসলমানদের অনুমতিক্রমে খলিফা হজরত উমর (রা.) তা হজরত আয়েশা (রা.)-এর খেদমতে পেশ করেন। তিনি ডিব্বাটি খুলে বলেন, হে খোদা! ইবনে খাত্তাবের উপকার বহন করার জন্য আমাকে আর জীবিত রেখ না। (মোস্তাদরেক) (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন