শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও কিছু কথা

প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল বাসেত
বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্কের দীর্ঘসূত্রিতা ও একজন শুভাকাক্সিক্ষ হিসেবে কিছু কথা না বললেই নয়। এটি অনস্বীকার্য সত্য উচ্চতর শিক্ষায় বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে, উচ্চতর শিক্ষা বিস্তারে কতটুকু মান বজায় রাখতে পারছে সেটিই প্রশ্ন ও বিবেচনার বিষয়। হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে ‘বাপ কি বেটা হায়’ আমরা যখন কোনো মনীষীর বা গুণীজনের জীবনী পড়ি, সেখানে এটি খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাঁর শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক অমুক বা তাঁর ছাত্র ছিলেন অমুক। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এরকম নজির টানার গর্ব দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, এদেশের শিক্ষকতা সম্মানজনক পেশা মনে করা হলেও একটু নিচু চোখে দেখতে সকলে অভ্যস্থ, সেটি প্রাইমারি থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত। যদিও এর রয়েছে নানাবিধ কারণ, কিন্তু কে ভাঙ্গাবে কার ঘুম। সম্প্রতি ঢাকাস্থ একটি নতুন স্কুলের শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা বোর্ডে আমন্ত্রিত হওয়ার সুবাদে বেশ অভিজ্ঞতার সুযোগ হয়েছে, যে অভিজ্ঞতার নির্মমতা ঐ বোর্ডে আমাকে দীর্ঘায়িত করার ধৈর্য হয়নি। মালিক পক্ষ ভাইভা গ্রহণকারী আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দকে নির্দেশনা দেন শিক্ষক নিয়োগপ্রার্থীদের মাসিক বেতনের প্রস্তাবনা রাখতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। বোর্ডে ছিলেন বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, গবেষকসহ আরো অনেকেই। কয়েকজনের ভাইভা শেষ হওয়ার পর বিবেকের তাড়নাকে আর ধরে রাখতে পারিনি। একপর্যায়ে অতিথিবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আমাদের এখানকার অনেকেই ব্যাংকার, শিক্ষক বা অন্য পেশায় আছেন। একটু চিন্তা করে দেখুন প্রত্যেকে কত বেতন পান? কিভাবে আপনার-আমার পক্ষে সম্ভব অনার্স-মাস্টার্স পাসকারী একজন ব্যক্তিকে এই বেতনে প্রস্তাব করার? শিক্ষকতার মতো মহান পেশা আমার-আপনাদের মতো লোকজনের দ্বারাই হচ্ছে ধ্বংস। শিক্ষকদের যথাযথ বেতন প্রদানে অপারগ হলে আনাচে-কানাচে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই। দৃষ্টিগোচর হলো বিষয়টি হৃদয়ে নাড়া দিল উপস্থিত সকলের। বড় আশ্চর্যের বিষয়, বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক শিক্ষক নিলেও আবেদন পড়েছে প্রত্যেক পদের পিছনে শতাধিক। আরো উল্লেখের বিষয়, এই বেতনেও সম্মত আছে অধিকাংশ প্রার্থী। দুর্বলতার সেই দিকটিই গ্রহণ করছেন মালিকপক্ষ। অথচ এই বিষয়টি সকলেই ওয়াকিবহাল স্বল্প বেতন দিয়ে ব্যাপক শিক্ষাবাণিজ্য করছেন উদ্যোক্তারা।
সম্প্রতি কাছের একজনকে একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি ব্যবস্থা করে দেয়ার সুবাদে জিজ্ঞাস করলাম, বেতন কত ধরেছে? বললো, খ-কালীন হিসেবে নিয়োগ দিল, দৈনিক ২২০ টাকা। রহস্যচ্ছলে ফোনে বলেই ফেললাম- ধং ষরশব ধং ফধু ষধনড়ঁৎ। মনে মনে অঙ্ক কষে দেখলাম ত্রিশ দিয়ে গুণ দিলে মাসিক বেতন পড়ে ৬৬০০ টাকা। অথচ এ চাকরি পেতে তাকে করতে হয়েছে অনেক দৌড়ঝাঁপ।
ভূমিকা এতটুকু টানার উদ্দেশ্য হলো মূল আলোচনাকে সহজ করা। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে উচ্চতর শিক্ষা বিস্তার ও গবেষণামূলক কর্মে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোই নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে এবং বিশে^র মেধাবী শিক্ষার্থীরা একটি আসনের জন্য সে বিশ^গুলোর দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতায় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা প্রয়োজন অনুভব করছেন উন্নত বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ধাঁচে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক।
দীর্ঘদিনের আশা-আকাক্সক্ষার ফসল শুরুটা ভালো হলেও কিন্তু ক্রমেই মান হারাতে বসেছে। বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়-শুধুমাত্র পড়ানোর জন্য নয়, বরং তার অন্যতম কাজই হবে গবেষণা করা, যার নির্যাসই হবে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন। হোক সরকারি বা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
উন্নত দেশগুলো দূরের বিষয় আমাদের পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সাথে তুলনা করে দেখা যায়, শিক্ষকতা পেশায় আমাদের বেতন কাঠামোর অনুপাত অনেক কম। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অন্যান্য চাকরির বেতনের অনুপাত অনেক বেশি ফলে অধিক মেধাবীরা আসছে না শিক্ষকতায়। উচ্চতর শিক্ষার নামে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। যে ফাঁকিটি গ্রহণ করেছে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।
আমাদের সমস্যাটি হলো সত্য কথাটি বললে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে যা অনেকের কাছেই অসহনীয়। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার শুরুটা যদিও ছিল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বা শিক্ষাবিদদের হাতে যা এখন চলে গেছে অনেকটা শিল্পপতিদের হাতে। একটি প্রবাদ আছে, ‘ঘরের মালিকই ভালো জানেন ঘরে কি আছে’। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের কলকব্জা নাড়াচাড়া করার কথা ছিল শিক্ষাবিদদেরই এবং যা যুক্তিযুক্ত। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় অনুমোদন দেয়ার উদ্দেশ্য এবং উচ্চশিক্ষা বিস্তারে এর গুরুত্ব তারা একটু হলেও বেশি বুঝতে পারেন এবং সমসাময়িক বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে কার্যকার পদক্ষেপ নিতেও সহজ হয়। বড়ই আফসোসের বিষয়, কিছুসংখ্যক বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় ব্যতীত অনেক বিশ^বিদ্যালয়েই এখন শিক্ষা থেকে ব্যবসাকেই প্রাধান্য পাচ্ছে। যত্রতত্র বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন, পূর্ব অনুমোদিত বিশ^বিদ্যালয়গুলো পূর্বশর্ত পূরণ না করতেই নতুন বিশ^বিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া কিসের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে?
যা না বললে নয়, দুঃখের সাথেই বলতে হয়, বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগকে এখন একজন দক্ষ ব্যবসায়ীর স্বল্প মজুরিতে অধিক শ্রম আদায়ের পলিসির মতোই দেখা যাচ্ছে। এমন অনেক বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে সদ্য পাস করা বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসাবে অহরহ নিয়োগ দিচ্ছে। স্বভাবত সদ্য পাস করা একজন শিক্ষার্থীর আর্থিক চাহিদা ততটা থাকে না। তবে হ্যাঁ, সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগের অন্যতম প্রক্রিয়াই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সর্বোচ্চ নাম্বারধারী বা মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। কিন্তু সেটাও একটা পদ্ধতির মধ্যেই হয়ে থাকে এবং সবচেয়ে মেধাবীজনই সেখানে স্থান পায়।
বয়সের স্বল্পতা ও চাহিদার ব্যাপ্তি থাকার কারণে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ শিক্ষককে দেখা যায় বিভিন্ন সরকারি, ব্যাংক ও লোভনীয় অন্যান্য পদের চাকরির জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে। তা যেমনি তাদের স্থিরতাকে করে দেয় নষ্ট, শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যকে করে ব্যাহত; তেমনি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ঘটে বিঘœতা। যদি এমন হয়ে পড়ে যে, কোনো বিশ^বিদ্যালয় বা বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষকের বয়সসীমা একই গ-িতে সীমাবদ্ধ, তাহলে ঐ বিভাগের শিক্ষার্থীরা গবেষণার হাতেখড়ি গ্রহণে কতটুকু অগ্রসর হবে? অথচ শিক্ষকতায় বয়সের অভিজ্ঞতা একটি বড় সম্পদ।
এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন, বিশ^বিদ্যালয় স্তরের গ্র্যাজুয়েশনের চারটি বছর শেষ করেও গবেষণার পটভূমি সম্পর্কেও পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়। এসাইনমেন্ট নামক একটি প্রোগ্রামের সাথে সম্পৃক্ততা থাকলেও অনেকটাই কাট, কপি, পেস্ট। কিন্তু পরিতাপের বিষয়-যা খতিয়ে দেখারও নেই কেউ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ক্লাসও হয়ে উঠে আড্ডা ও বিনোদন মেলায়। সম্পর্ক গড়ে উঠে বন্ধুত্বের। এর ইতিবাচক দিক থাকলেও নেতিবাচকটিই প্রাধান্য।
এমনতো আর নয় যে, অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে কিংবা শিক্ষার্থীদের থেকে আদায়কৃত টিউশন ফি’তে অধিক সম্মানিতে শিক্ষক নিয়োগ অসম্ভব। শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখেন: বুলি ও লেখনীতেই শুধু সীমাবদ্ধ থেকে, কল্পনার জগতে খুব বেশি বিচরণ না করে তাদের বাস্তবতায় ফিরে আমা উচিৎ। বিশে^র স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর মতো আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলোকেও আমরা দেখতে চাই। দেখতে চাই বিশ^বিদ্যালয়গুলো দেশ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে গবেষণালব্ধ কর্ম সম্পাদনে অবদান রাখছে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন