কে, এস, সিদ্দিকী
(১৫ জুলাই প্রকাশিতের পরে)
আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে তার নিকট প্রচুর হাদিয়া উপহার আসতো। তার নির্দেশ ছিল যে, প্রতিটি উপহারের বিনিময় প্রদান করতে হবে। হজরত আমীর মোয়াবিয়া (র.)-এর নিকট তাঁর আবাসগৃহ বিক্রি করে দেন এবং বিক্রিলব্ধ সমুদয় অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করেছেন। উম্মুল মোমেনিনের জীবন অনুরূপ ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ।
কোনো কোনো সাহাবা বর্ণনা করেছিলেন যে, নামাজির সামনে দিয়ে যদি নারী, কুকুর এবং গাধা যায় তাহলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যাবে। বর্ণনাটি শোনার পর উম্মুল মোমেনিন মন্তব্য করেন এটি কোন হাদিস নয়। যারা এ বর্ণনা করছে তারা খুবই মন্দ কাজ করছে। তারা নারীকে পশুর সাথে তুলনা করছে। এবং বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজ পড়তেন এবং আমি তার সামনে শুয়ে থাকতাম। আরো বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায় যে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, যখন হুজুর (সা.) নামাজের সেজদা করতে চাইতেন তখন আমার পা ঠেলে দিতেন এবং আমি পা সংকুচিত করে নিতাম (আবু দাউদ)। ফকিহগণের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন যে, নারী এমন অপবিত্র বস্তু, সে ছুঁইলে অজু ভেঙে যাবে কিন্তু উম্মুল মোমেনিনের উল্লিখিত বর্ণনা তাদের ইজতেহাদী ভুলের মুখোশ উম্মোচিত করে দেয়।
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অশুভ তিনটি বস্তুতে বিদ্যমান ঘোড়া, ঘর এবং নারী। হজরত আয়েশা (রা.) এ কথা শুনে অত্যন্ত রাগান্বিত হন। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম সেই জাত সত্তার, যিনি মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি কোরআন নাজিল করেছেন, তিনি এ কথা কস্মিনকালেও বলেননি। তবে তিনি বলেছেন যে, জাহেলি যুগে লোকেরা তাদের দ্বারা অশু-শুভের ধারণা পোষণ করত। বর্ণনাকারীর এক শাব্দিক ভুল কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ উল্লিখিত বর্ণনা। যার জন্য উম্মুল মোমেনিন বলতে বাধ্য হয়েছেন, আমাদেরকে গাঁধা ও কুকুরের সমমর্যাদায় এনে ছেড়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, নারীবিদ্বেষী একশ্রেণীর লেখক এবং মসজিদের কিছু অজ্ঞ ইমাম ওয়াজে বাহবা কুড়ানের জন্য উল্লিখিত খ-িত হাদিসটির আসল যাচাই না করে ঢালাওভাবে তা প্রচার করে থাকেন এবং লিখে থাকেন। জাহেলি যুগের আরবদের মধ্যে প্রচলিত বহু অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ইসলাম বাতিল ঘোষণা করেছে। কোনো রাবীর ভুল বর্ণনায় এরূপ অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নামাজির সম্মুখ দিয়ে নারীর গমন নামাজ বিনষ্ট করে এরূপ অন্ধ বিশ্বাস হজরত আয়েশা (রা.) বাতিল করে মুসলিম রমনীকুলের বিশেষত সাধারণভাবে মুসলমানদের বিরাট উপকার করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর ন্যায় প্রথম সারির মুফতি সাহাবির কোনো কোনো রায় অর্থাৎ ফতোয়া হজরত আয়েশা (রা.) দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হজরত ইবনে উমর (রা.) ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, নারীরা শরয়ী পবিত্রতার জন্য (গোসলের সময়) মাথার চুলের জোড়া বা খোঁপা খুলে গোসল করবে। হজরত আয়েশা (রা.) শুনে বললেন, তিনি এই ফতোয়া কেন প্রদান করেন না যে, নারীরা তাদের মাথা ন্যাড়া করে ফেলবে এ কথা ব্যক্ত করে তিন বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে গোসল করতাম এবং মাত্র তিনবার পানি ঢালতাম। এটি মুসলিমের বর্ণনা এবং নাসায়ির বর্ণনায় আছে এবং একটি চুলও খুলতাম না। এরূপ আরো অনেক মাসআলায় সাহাবাগনের অধিকাংশই হজরত আয়েশা (রা.)-এর ফতুয়া অনুযায়ী করতেন। তবে যেসব বিষয়ে তাদের এবং হজরত আয়েশা (রা.)-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিতো, সেগুলোর সংখ্যা কম নয়। ওইসব বিষয়ে হেজাজের আলেম ও ফকিহগণ হজরত আয়েশা (রা.) এর মতকেই সমর্থন করেন। বিরোধমূলক বিষয়গুলোর মধ্যে নারী সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় উদাহরণ হিসেবে নি¤েœ প্রদত্ত হলো, যাতে উম্মুল মোমেনীনের মত প্রতিফলিত । যথাÑ
১। চুম্বনে অজু নষ্ট হয় না।
২। গোসলের সময় নারীর চুল খোলা জরুরি নয়।
৩। দাফনের সময় নারী মুর্দারের মাথার চুল খোলা থাকবে, বাঁধা যাবে না।
৪। নামাজের সময় নারী সামনে থাকলে নামাজ বাতিল হয় না।
৫। হজের সময় নারীর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, মাথার চুলের কেবল কোনো এক দিকের সামান্য চুল কর্তন করবে।
৬। সোনা রূপার ব্যবহার্য অলংকারে জাকাত নেই।
৭। যদি প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো লোকও কোনো নারীর দুধ পান করে, তাহলে হুরমত সাব্যস্ত হবে।
৮। গর্ভবর্তী বিধবা হলে তার ইদ্দত হবে প্রসব।
৯। স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক ও পৃথক থাকার অধিকার প্রদান করে এবং স্ত্রী এ অধিকার প্রত্যাখ্যান করতঃ স্বামীকেই পছন্দ করে তা হলে তালাক হবে না।
১০। যাকে তিন তালাক দেওয়া হয়েছে সেও ইদ্দতকাল তার স্বামীর গৃহে থাকবে ইত্যাদি।
সোনা ও রূপার ব্যবহার্য অলংকারের জাকাত দিতে হবে নাÑ হজরত আয়েশা (রা.)-এর মতের বিরোধী সাহাবিদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ও হানাফি ফকিহগণ। তবে ইবনে উমর (রা.), আনাস ইবনে মালেক (রা.) এবং জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) এর মতে জাকাত দিতে হবে না। ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমদের মতও তাই। উম্মুল মোমেনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, তথা সর্ব প্রকারের গুণাবলী এবং চারিত্রিক সব বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়েছিল প্রত্যক্ষ নবুওয়াত ইলমের বদৌলতে মহানবী (সা.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে তিনি উম্মুল মোমেনিনের বিরল মর্যাদা লাভ করার পাশাপাশি তখনকার দিনে আরবে প্রচলিত অনেক শাস্ত্রে এবং বিদ্যা জ্ঞানে ছিলেন পারর্দশী। নবী ঘরানার এ মহীয়সী জননী অহীর ইলম কোরআনী জ্ঞান ভা-ারে মুসলিম রমনীর মধ্যে তিনি ছিলেন একক ও অদ্বিতীয়া। তিনি পবিত্র কোরআনের একটি সংকলনও প্রণয়ন করেছিলেন। মুসলিম নারীদের মধ্যে তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা সর্বাধিক। অধিক হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ এবং তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি। এগুলোর মধ্যে বোখারি ও মুসলিমে ২৮৬টি, উভয়ের মধ্যে যৌথ হাদিসের সংখ্যা ১৭৪টি। ৫৪টি হাদিস এমন রয়েছে যা কেবল বোখারিতে এবং ৫৮টি কেবল মুসলিমে স্থান পেয়েছে। এ হিসেবে বোখারিতে ২২৮টি এবং মুসলিমে ২৩২টি হাদিস রয়েছে এবং বাকি হাদিসমূহ বিভিন্ন গ্রন্থে বিদ্যমান। কেবল কোরআন ও হাদিস নয়, উম্মুল মোমেনিন ফেকা, কিয়াস, কালাম, আকায়েদ, আসরারেদ্বীন, তিব্ব (চিকিৎসা), ইতিহাস, সাহিত্য, বক্তৃতা, কাব্য, শিক্ষা, ফতোয়া, ইরশাদ প্রভৃতি শাস্ত্র ও বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। আরবি কাব্য সাহিত্যের প্রতিও ছিল তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। প্রাচীন কবিদের অজ¯্র কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। তিনি নিজেও কবিতা রচনা করতেন । তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শানে কবিতা রচনা করেছেন । নমুনাস্বরূপ দুটি ছত্র নি¤œরূপ :
“লানা শামসুন ওয়ালিল আফাকেশামসুন।
ওয়া শামসি আফ্জালু শামসিস্ সামায়ি ॥
ফাইন্না শামসা তাত্ লাউ বাদা ফাজরিল।
ওয়া শামসি তাত্লাউ বাদাল এশায়ি ॥”
অর্থাৎ আমাদের একটি সূর্য আছে, জগৎবাসীদেরও একটি সূর্য আছে। আমার সূর্য জগতের সূর্যের চেয়ে উত্তম। জগতের সূর্য উদিত হয় ফজরের পর আর আমার সূর্য উদিত হয় এশার পর।
নারী জাতি নারী হিসেবে বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেও তারা পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং জাগতিক বহু দায়িত্ব ও সেটা কার্য আঞ্জাম দিতে পারে, তাদের অস্তিত্ব ইসলামে নারী অধিকারগুলোর প্রমাণের জন্য দলিলস্বরূপ। ইসলাম তাদের মর্যাদা দান করেছে এবং তাদের পূর্ব অবনত অবস্থাকে যতটুকু উন্নত করে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে, উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা (রা.) এর জীবন ইতিহাস তার বাস্তবচিত্র। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অতি উঁচুমানের এমনও অনেকে ছিলেন, যারা মাসীহে ইসলাম খেতাব পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। যেমন হজরত আবুজর গিফারী (রা.) প্রমুখ। আল-হামদু লিল্লাহ। মহিলা সাহাবীদের মধ্যে মরিয়ামে ইসলাম হওয়ার যোগ্য ছিলেন উম্মুল মোমেনীন। তিনিই ছিলেন মহিলা সাহাবীদের নানা দাবী-দাওয়া ও সমস্যাবলী রাসূল্লাহ (স.)-এর দরবারে উপস্থাপনকারী একমাত্র মুখপাত্র সম্ভাব্য সকল প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতা তিনিই তাদের করতেন।
নারীদেরকে যারা হেয় বা নিকৃষ্ট মনে করতো উম্মুল মোমেনীন তাদের প্রতি খুবই অসন্তুষ্টি হতেন। কোনো ব্যাপারে কেউ যদি তাদের দোষত্রুটি এবং অপমানের দিক বের করার চেষ্টা করতেন তিনি তা দূর করে দিতেন যাতে সংশয়ের অবকাশ থাকতো না। এ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে যে, কেউ কেউ বর্ণনা করেছিলেন যে, নারী, কুকুর এবং গাধা যদি নামাজির সম্মুখ দিয়ে চলে যায় তাহলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যাবে। বর্ণনাটি শুনে হজরত আয়েশা (রা.) বললেন: ‘‘ইন্নাল মার আতা ইজান দাব্বাতুল সাওদীউ অর্থাৎ তাহলে নারীও একটি ঘৃণ্য পশু। তিনি বললেন বিসামা আদিল তুমনা বিল হিমারি ওয়াল কালাবি। অর্থাৎ তোমরা খুবই মন্দ করেছ যে, আমাদেরকে গাধা ও কুকুরের সমান করে ফেলেছ। রাসূলুল্লাহ (স.) নামাজ আদায় করতেন এবং আমি তার সম্মুখে শুয়ে থাকতাম। (তায়ালিমী)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন