আহসান উল্লাহ
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কিছু মানুষ উগ্রবাদের সাথে সবসময়ই জড়িত ছিল। এই উগ্রবাদের সাথে ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা আঞ্চলিকতা কোনভাবেই জড়িত নয়। তবে একজন সরলপ্রাণ তরুণকে জঙ্গি বা উগ্রবাদী বানানোর ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা আঞ্চলিকতাকে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল অত্যন্ত চতুরতার সাথে ব্যবহার করেছে। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সমস্যা আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশে আজও বড় একটি ইস্যু হয়ে আছে। আমেরিকায় বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সারা বিশ্বের কালো মানুষগুলোর সাথে বিশ্ববাসীও খুশিতে লাফিয়ে উঠেছিল এই ভেবে যে, সাদা-কালোর দাঙ্গা বুঝি আমেরিকার ইতিহাস হয়েই থাকবে কিন্তু তা আর হলো না। সব সাদা মানুষেরা যেমন কালোদের অধিকার মেনে নিতে পারেনি তেমনি সব কালো মানুষও সাদাদের মেনে নিতে পারেনি। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া ঘটনা তারই জলন্ত প্রমাণ। ভারতে উগ্রহিন্দু মৌলবাদীদের কর্মকা-, হিটলারের ইহুদি নিধনের মিশন, মায়ানমারে মুসলিম বিদ্বেষী বৌদ্ধদের কর্মকা- সবকিছুর পিছনে রয়েছে উগ্রবাদী কতিপয় বিপদগামী ব্যক্তি। বাংলাদেশ এর থেকে ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। প্রতিবেশী অনেক দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও আমাদের এই দেশে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত সকল ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক সাথে সাম্যের গান গেয়ে গেছে। সবাই দেশের জন্য দেশের জন্য মানবতার জন্য কাজ করতে সদা তৎপর। আজ হঠাৎ জঙ্গি নামক একটি সাইক্লোন সবকিছু উলট-পালট করে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? কি জন্য দামাল ছেলেরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উগ্রবাদের দিকে ছুটছে? উত্তর অনেক শুনেছি, রাজনৈতিক উত্তর, সাহিত্যিক উত্তর, চিন্তাবিদের উত্তর, ফেসবুকের উত্তর, টুইটের উত্তর, উত্তরের অভাব নেই। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর চোর ধরার অনেক বুদ্ধি দেয়ার লোক যেমন বেরিয়ে আসে তেমনি জঙ্গি বা উগ্রবাদীরা কোন কিছু ঘটানোর পর মিডিয়াতে অনেক কিছুই বের হয়ে আসে।
আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, নিজে না খেয়ে হুজুরকে খাওয়ানোর লোকের যেমন অভাব নেই তেমনি সবকিছু উজাড় করে ব্রহ্মণ ভোজন করার ইতিহাসেরও অভাব নেই। জন্ম সূত্রে পাওয়া এই ধর্মীয় বিশ্বাসকে সহজে একজন তরুণের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মনীতি ঠিক করা দরকার ছিল যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শতভাগ কার্যকর হয়নি বলে আমার বিশ্বাস। আমরা প্রাশ্চাত্য সভ্যতাকেও রপ্ত করতে পারিনি এবং নিজেদের ঐতিহ্যকে লালন করতে পারিনি। ফলে মাঝামাঝি এক অদ্ভুত জাতিতে আমরা পরিণত হচ্ছি দিন দিন। এই সুযোগটা একটি মহল কাজে লাগাচ্ছে, কিছু তরুণ-তরুণীকে বিপথে টেনে নিয়ে, আর আমরাও সেই পথকে অজান্তে সহযোগিতা করছি।
বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রমকারী সন্তানদের মনে হাজারো প্রশ্নের অবতারণা হয় কিন্তু আমরা এই সকল বিষয় অনেকাংশে এড়িয়ে চলি। কখনো জানতে চাইনি তার আবেগ-উচ্ছ্বাস, মূল্যায়ন করেনি তার অভিমত, বুঝতে পারিনি তার অভিমান, সঙ্গী হতে পারেনি তার জীবন চলার পথে। আমরা ব্যস্ত অভিভাবকরা যখন ব্যর্থ তখন আমাদের সন্তানেরা নদীর মতো আপন গতিপথ ঠিক করে নেয়। হারিয়ে যায় মূলধারা থেকে অনেক দূরে। যারা ধর্ম-কর্মে তেমন বিশ্বাস করে না তারা ডুবে যায় অন্ধকার হাজারো অলি-গলিতে যা থেকে আর কখনো আলোর পথে ফিরে আসতে পারে না। ঐশীর মতো হাজারো উদাহারণ আছে ঘরে ঘরে। জীবন সংগ্রামে যারা ব্যর্থ, যারা হতাশায় সাতরে বেড়ায়, যারা বেঁচে থাকাকে অর্থহীন মনে করে তাদেরকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এতে মনে হয় তারা সফলও হয়, গুলশান ট্রাজেডির যারা খলনায়ক তাদের প্রোফাইল অন্তত তাই বলে।
মুসলমান সন্তানদের সবচেয়ে দুর্বলতম দিক হলো ধর্মীয় বিষয়। এর কারণও আছে সারা বিশ্ব শাসন করা এই মুসলিম জাতি আজ শোষণের শিকার। এই অধঃপতনের কারণ ও সোনালী অতীত ফিরে পেতে করণীয় কী ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন ধর্মপ্রাণ তরুণদের অন্তরে প্রশ্নাকারে আসে। আর আসাটাই স্বাভাবিক। যদি না আসে তাহলে জঙ্গিদের প্রথম কাজ হলো এই প্রশ্ন একজন কৈশোর পেরুনো তরুণ হৃদয়ে উত্থাপন করা। তারপর এর উত্তর খোঁজার ব্যাপারে কৌতূহলী করে তোলা। ইসলামী জ্ঞানের সল্পতার সুযোগ নিয়ে শুরু হয় মগজ ধোলাই। আর আমরা অভিভাবকরা তো ইসলামের যথার্থ জ্ঞান কখনো অর্জন করিনি, ফলে সন্তান যখন ধর্ম-কর্মে মনোযোগী হয় তখন আমরাও একটু আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে থাকি। আমরা ভুলে যাই যে, সন্তানকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না রেখে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা দেয়াটা জরুরি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অভাব, উচ্চশিক্ষায় তো একেবারেই নেই। ফলে একজন তরুণ মুসলিম ইসলামের জেহাদ আর সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। সুযোগটা শতভাগ কাজে লাগায় জঙ্গিরা। অতি সহজে কিছু তরুণ স্বর্গে যাওয়ার মহাপ্রলোভনের হাতছানিতে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গিবাদে। কথা হচ্ছে, ইসলামকে জানা অবাধ সুযোগ তৈরি করতে হবে, জানার ক্ষেত্রটা হতে হবে সঠিক অনেকটা ভেবে চিন্তে, যাচাই-বাছাই করে ইসলামকে জানার ক্ষেত্র নির্বাচন করতে হবে যাতে সঠিক জ্ঞান লাভের মাধ্যমে ইসলামকে মানতে পারে। তাহলে জঙ্গিবাদ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা ভয়াবহ মন্দ ও খারাপ কাজ তা বুঝতে পারবে।
লক্ষ্য করুন আপনার সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে এমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কিনা। যদি হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তবে কাউন্সিলিং করুন, পরিবর্তনের উৎস সম্পর্কে অবগত হোন। ইসলামের সঠিক জ্ঞান পাওয়ার লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে যেন না পরতে হয় সতর্ক থাকুন।
লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষক
দি জাকাত ফাউন্ডেশন অব আমেরিকা
বাংলাদেশ কান্ট্রি অফিস
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন