বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পানি, সীমান্ত ও বাণিজ্য নিয়ে কথা হতে পারতো

প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বেনাপোল-পেট্রোপোল ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট উদ্বোধন করেন। ভিডিও কনফারেন্সে দেয়া বক্তব্যে নরেন্দ্র মোদি গুলশান ও শোলাকিয়াসহ মন্দির, পুরোহিত, সাধারণ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ কঠিন পরীক্ষার সময় পুরো ভারত আপনার সঙ্গেই আছে। আপনি সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে যেভাবে ধৈর্যের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতে আমি মন থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিজের এই লড়াইয়ে আপনি নিজেকে কখনো একা ভাববেন না, ভারতের পূর্ণ সমর্থন আপনার সাথে আছে। এই লড়াইয়ে ভারত আপনাকে সব ধরনের সহায়তা দিতে সব সময় প্রস্তুত। আরো বলেন, পেট্রোপোল ও বেনাপোল বন্দরের ইন্টগ্রেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। এটা দুই দেশের সার্বিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ দরজা। দুই দেশের যৌথ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশে ঘটনা ঘটিয়ে ভারত গিয়ে পালাবে, ওখানে ঘটনা ঘটিয়ে এ পাড়ে এসে পালাবে, এটা চলবে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের দুই দেশের মধ্যে সবসময় সহযোগিতা থাকবে। কোনো দেশই সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবো না। তিনি বলেন, দুই দেশের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। আর্থ-সামাজিক উন্নতি করতে হলে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে একটা সদ্ভাব থাকা একান্ত প্রয়োজন। ভারতের সাথে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট উদ্বোধন নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। প্রতিবেশি দেশগুলো একে অপরের বিপদে-আপদে পাশ দাঁড়াবে এবং সমতাভিত্তিক পারস্পরিক উন্নয়ন সহযোগী হবে, এটাই কাম্য।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিবেশি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের মাপকাঠি এক নয়। প্রতিবেশির সাথে প্রতিবেশির যে সমমর্যাদা, সমআচরণ এবং ন্যায্য অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা তা দেখতে পাই না। এ সম্পর্ক অনেকটা একতরফা। বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে এ আচরণই প্রতীয়মান হয়, সে যেন আমাদের বড় ভাই। বাংলাদেশের প্রতি ভারত তার স্বার্থের অনুকূল বা তার যা যা চাওয়া-পাওয়া সবই আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশও তার চাওয়া দু’হাত উজাড় করে দিয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশের জীবন-মরণের সাথে জড়িয়ে থাকা যেসব বিষয় ভারতের করতলে রয়েছে, তার কিছুই পায়নি। বাংলাদেশের ন্যায্য পানি প্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে ভারতের নিদারুণ অন্যায্য আচরণের কথা সকলেরই জানা। ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি ভারত আন্তর্জাতিক সকল নীতি-রীতি লঙ্ঘন করে নিজের ইচ্ছা মতো বাঁধ, গ্রোয়েন, ইত্যাদির মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফারাক্কা নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, এক্ষেত্রে চুক্তিটিই কেবল দৃশ্যমান। চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য পানি দৃশ্যমান নয়। চূড়ান্ত হয়ে থাকা তিস্তা চুক্তি হিমঘরে চলে গেছে। পানি নিয়ে ভারতের এই আচরণের কারণে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো একে একে মরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অসংখ্য নদ-নদী নাব্য হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল ভূ-খ- মরুকরণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। সীমান্তে নদ-নদীর ভাঙনে দিন দিন ভূ-খ- হারাচ্ছে বাংলাদেশ। মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করে বাড়ি-ঘর, ফসল, গবাদিপশু ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে এখন যে বন্যা দেখা দিয়েছে, এটা তারই ফল। অর্থাৎ পানির ন্যায্য প্রাপ্য নিয়ে ভারতের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে বাংলাদেশকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি ধরে রাখার জন্য যে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে, তাও ভারতের আপত্তির কারণে স্থগিত হয়ে আছে। শুধু নদ-নদীর পানি নিয়েই ভারত নিষ্ঠুর খেলা খেলছে না, সীমান্তে তার সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই গুলি ও নির্যাতন করে বাংলাদেশের মানুষ মারছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অনেকটা জোর-জবরদস্তির মাধ্যমেই জিরো লাইনে বেড়া নির্মাণ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কাছে তার চাওয়ার সবই আদায় করেছে। ট্রানজিটের নামে করিডোর এবং এই করিডোর দিয়ে মালামাল নেয়ার যে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও তার ইচ্ছানুযায়ী করা হয়েছে। তার আগে বিনা মাশুলেই মানবিকতার আবেদন করে তার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা করে দিনের পর দিন মালামাল নিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলোর প্রতি ভারত কোনো ধরনের মানবিকতা দেখায়নি, দেখাচ্ছেও না। এসব ক্ষেত্রে তাকে বিন্দুমাত্র সহমর্মী হতে দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। বাণিজ্য সমতা আনার ক্ষেত্রেও ভারত চুল পরিমাণ ছাড় দিচ্ছে না। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে উচ্চহারে শুল্ক নির্ধারণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সম্পর্কের এমন ব্যাপক বৈষম্য নিয়ে যে সুসম্পর্কের দাবী করা হচ্ছে, তা কতটা যুক্তিযুক্ত এবং প্রতিবেশির প্রতি সমআচরণের পর্যায়ে পড়ে কিনা, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উচ্ছ্বসিত হতেই পারেন, কারণ বাংলাদেশের কাছে তার চাওয়ার সবই আদায় করে নিয়েছেন। বাকি আর কিছু নেই। এখন তিনি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতা করার মতো সুন্দর সুন্দর কথার ফুলঝুরি ছড়াতে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই পারেন। তবে তার এসব মিষ্টি-মধুর কথা যে বাংলাদেশের মানুষের মন ভিজাতে পারেনি, তাতে সন্দেহ নেই।
দুটি দেশের সরকার প্রধান যখন কোনো একটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি হন বা কথাবার্তা বলেন, তখন নির্ধারিত এজেন্ডার বাইরেও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ই উঠে আসে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে ইস্যুতে মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্ত সংক্রান্ত জটিলতাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারত। ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলার এটা একটা বড় সুযোগ ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, বাংলাদেশকে সবধরনের সহযোগিতা দেবেন, তখন উল্লেখিত ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাওয়ার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল এবং এ প্রসঙ্গগুলো উত্থাপন করা উচিত ছিল। বিশেষ করে তিনি যে আবেগী ও সহমর্মী হয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, এ সময় বাংলাদেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো তুলে ধরা যেত। বাংলাদেশের তরফ থেকে এ সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন