আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের উপর তার পারিপার্শি¦ক সমাজ ও জগতের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত কিছু বিধান দিয়েছেন। একজন শাসক তার জনগণের বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং তাদের কল্যাণের বিষয়ে তাকেই জবাবদিহি করতে হবে। হাদিস শরীফে আছে, ‘অতএব সতর্ক হও। তোমরা সবারই (যার যার পরিমন্ডলে) দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে (বুখারী, মুসলিম)।’ পুলিশ জনগণের বন্ধু। জনগণের সেবক। এটা বলা হলেও তাদের কিছু সদস্যর কারণে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের নিষ্ঠুরতায় পুলিশ বাহিনীর মানবিকতা ও উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় এ বাহিনীর সুনাম যেমন আমাদেরকে আলোড়িত করে, তেমনি এ বাহিনীর কিছু সদস্যের অপকর্মও আমাদের ব্যথিত করে। বলা বাহুল্য, এ বাহিনী কোন দল বা গোষ্ঠীর একক সম্পদ নয়। অথচ পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষতার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যারাই ক্ষমতায় থাকেন, তারাই এ বাহিনীকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাতে ব্যবহার করা হয়েছে এবং করছে। ফলে এ বাহিনীর বদনাম হয়েছে। এতে পুলিশের অনেক ইতিবাচক এবং কৃতিত্বপূর্ণ খবরও ঢাকা পড়ে যায়। বিশ্বজুড়ে করোনার নিষ্ঠুরতা থামবে কি থামবে না, এর গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না। জ্যামিতিক হারে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এ ভাইরাসের নিষ্ঠুরতায় পুরো বিশ্ব যখন নাজেহাল, সন্তান যখন মাকে জঙ্গলে কিংবা রাস্তায় ফেলে রেখে যাচ্ছে, তখন আমাদের পুলিশ বাহিনী পরিবার পরিজনের কথা না ভেবে জনগণের কল্যাণে নিজের জীবন তুচ্ছ করে নিবেদিত হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর এ ত্যাগের কথা হয়ত আমরা ভুলে যাব। কিন্তু ভুলে যাবে না বাংলাদেশ।
পুলিশ একটি সেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা তার অন্যতম দায়িত্ব। অপরাধ ও অপরাধীর প্রতি কঠোর এবং নিরপরাধ জনসাধারণের প্রতি কোমল এবং তাদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত পুলিশের বিধি বিধানের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাদের এই সেবামূলক কাজের ব্যাঘাত ঘটে। ফলে তাদের অনেক অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে হয়। তবে করোনাকালে পুলিশের যে দায়িত্ব তা যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং জনগণের দ্বারা প্রশংসিত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর যে মানবিকতা আমরা দেখেছি, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এ বাহিনীর সুনামের কথা তেমন একটা শোনা যেত না। করোনা সংকটে তাদের মানবিকতা সত্যিই আমাদেরকে প্রেরণা জুগিয়েছে। মানবিকতার এ কাজ করতে গিয়ে হাজারো পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং বেশ কজন মারা গেছেন। এ বাহিনী করোনা প্রতিরোধ আন্দোলনে এক অনন্য ভূমিকার জন্য দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে চলেছে।
দেশের নাগরিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশ সম্পর্কে একটা বিরুপ ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, পুলিশের কাছে সাহায্য চাওয়া মানে নিজের বিপদ নিজে টেনে আনা। সেজন্য মানুষ বাধ্য না হলেপুলিশের দ্বারস্থ হয় না। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর মানবিকতার বিষয়গুলো মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। নতুন পথ দেখিয়েছে। নতুন এক পুলিশ বাহিনীকে চিনতে শুরু করেছে।
বিশেষ করে লকডাউন শুরুর দিন হতে পুলিশ বাহিনীর কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এই দুঃসময়ে তারা মাস্ক, স্যানিটাইজার ও খাবারের প্যাকেট বিলি করেছেন এবং করে যাচ্ছে। রাতের আধাঁরে অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। প্রসববেদনায় ছটফট করা নারীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছে। তাঁদের মধ্যেও যে মানবিকতা, উদারতা, মনুষ্যত্ববোধ আছে, তা করোনা দেখিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লায় পারভেজ মিয়া নামে হাইওয়ে পুলিশের এক কনস্টেবল সাহসিকতা ও মানবসেবায় এক অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডোবায় পড়ে গেলে পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ মিয়া যাত্রীদের জীবনরক্ষায় ছুটে যান। পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত ডোবার পানিতে যেখানে সাধারণত মানুষ নামতে চায় না সেখানে পচা ডোবায় কনস্টেবল পারভেজ জীবনের ঝুকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নিমজ্জিত বাসের ভেতর ঢুকে একাই পানির নিচ থেকে একে একে ২২ জন যাত্রীর জীবন বাঁচিয়েছেন। মানুষের জীবন বাঁচানোর এ দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। চারদিকে যখন খাবারের আর্তনাদ তখন মানুষের পাশে ভিন্ন এক উদ্যোগ নিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ দাঁড়িয়েছে। মানুষকে ঘরে রাখতে তারা পৌঁছে দিচ্ছে খাবার সামগ্রী। ¯েøাগান দিয়েছে, বাসায় থাকুন দোকানই যাবে আপনার কাছে। লকডাউনে যখন পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ তখন পুলিশ পৌঁছে দিচ্ছে ডাক্তার নার্সদের হাসপাতালে। বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারান্টিনে থাকা নিশ্চিত করতে বাড়িতে বাড়িতে খাবার সামগ্রী পাঠিয়েছে। বিদেশিদের হোম কোয়ারান্টিনে রেখেছে কড়া নজরদারিতে। করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফনে স্বজনরা এগিয়ে না এলেও পুলিশ ঠিকই এগিয়ে গেছে। এখন এ আস্থা সৃষ্টি হয়েছে করোনায় কেউ মারা গেলে আর কেউ না এলেও আমাদের পুলিশ এগিয়ে আসবে। করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে সন্দেহে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে পড়ে থাকা লাশটির কাছে কেউ যায়নি। অবশেষে পুলিশ কনস্টেবল রুবেল লাশটি রিকশাভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ ও অনাস্থা ছিল, তা অনেকটাই করোনার কেটে গেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আস্থার সংকট দূর হবে।
কোথাও সংঘর্ষ, মারামারি, দুর্ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যা-ই ঘটুক, তা সামাল দিতে সবার আগে পুলিশ পৌঁছে যায়। এটা পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে কিছু পুলিশের নিষ্ঠুরতার কারণে জনমনে বরাবরই পুরো বাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। অথচ এ বাহিনীর হাজারো সদস্য ২৪ ঘন্টায় ১৬ থেকে ২০ ঘন্টা ডিউটি করে আমাদের নিরাপত্তার জন্যে। আমরা যখন রাতে ঘুমিয়ে পড়ি তখন তারা রাতের ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সামান্য একটু রোদে কিংবা বৃষ্টিতে আমরা যখন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে ছুটে যাই, তখন রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে পুলিশ বাহিনী দায়িত্বপালন করে। দেশের জনগণের কথা বিবেচনা করে পরিবার-পরিজন রেখে শুধু দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই এ বাহিনীর সদস্যরা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। করোনা হয়তো চিরদিন থাকবে না। কিন্তু আমরা চাই করোনা-পরবর্তী সময়েও পুলিশ জনগণের যে আস্থা সৃষ্টি করেছে তা অটুট থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন