শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলে করণীয়

প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম এ মান্নান
সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদেরকে নবী কারীম (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলে তিনি যে ফর্মূলা বা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন আমরাও যদি সে পথ অনুসরণ করি তবে তা সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবে যেসব নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকা- সংঘটিত হয়েছিল তা সকল যুগের সব সন্ত্রাসী কর্মকা- ও বর্বরতাকে হার হানায়। অথচ নবীজি (সা.) তা জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি যে নীতি অবলম্বন করে ওইগুলোর মূলোৎপাটন করেছিলেন আমাদেরকেও সেই নীতি অবলম্বন করতে হবে। তাছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকা- রোধ করা সম্ভব নয়। আরবের বড় বড় সন্ত্রাসী নবীর নীতির সামনে মাথানত করে সন্ত্রাসী কর্মকা- বর্জন করত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। হেন কোনো মন্দ কাজ নেই যা তারা করেনি। জুলুম নির্যাতন, চুরি ডাকাতি, ছিনতাই রাহাজানি, জিনা, ব্যভিচার ও হত্যার মতো কর্মকা- সে সময় অহরহ সংঘটিত হতো। ওইসব জুলুম ও অন্যায়, অত্যাচার নির্মূলের লক্ষ্যেই আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে। নবুয়ত প্রাপ্তির পরে নয় পূর্বেও তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন।
তখন কুরাইশ তথা বনু হাশেম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ, বনু যুহরা ও বনু তাইমসহ বেশ কয়েকটি গোত্র মিলে আরবের জালিমদের বিরুদ্ধে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে যে সংগঠন গড়ে তুলেছিল বিশ বছর বয়সী যুবক মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন তাঁদের প্রেরণাদাতা। ওই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সন্ত্রাস ও যাবতীয় মন্দ কাজের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
ওই সংগঠনের অন্যতম শর্ত ছিল যে, মক্কা নগরীতে দেশি বা বিদেশি কারো ওপর কোনো প্রকার জুলুম করা হবে না। করলে জালিম ব্যক্তিকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। মজলুমকে সাহায্য করতে জালিমের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে। জালিম বা অত্যাচারী ব্যক্তি উঁচু শ্রেণির নাকি নিচু, স্থানীয় নাকি বিদেশি, তা বিবেচনা করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মজলুমের হক আদায় না হবে। এভাবে সমাজ থেকে অন্যায় অত্যাচার ও সন্ত্রাস দমনে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূমিকা রাখেন। কাফিরদের অত্যাচারে তিনি নিজে মক্কা ত্যাগ করেন। মদিনায় গিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সেখানের লোকদের সাথে তিনি একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যা মদিনা সনদ নামে খ্যাত। ৪৭টি ধারা সম্বলিত এ সনদ সন্ত্রাস প্রতিরোধের এক অনন্য দলিল। এ সনদের একটি ধারা হলো, তাকওয়া অবলম্বনকারী ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অবস্থান নেবে, যারা বিদ্রোহী হবে অথবা বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যায় পাপাচার, সীমা লঙ্ঘন, বিদ্বেষ কিংবা দুর্নীতি ও ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর হবে, সবাই সমভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে যদিও সে তাদেরই আপন পুত্রও হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক মদিনা সনদে সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য বেশ কিছু ধারা ছিল। যেমন- ১. মদিনায় রক্তক্ষয় এবং অন্যায় নিষিদ্ধ করা হলো। ২. চুক্তিবদ্ধ কোনো সম্প্রদায়ই বাহিরের কোনো শত্রুর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না। ৩. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। ৪. মুসলিম ও অমুসলিম বিভিন্ন সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ব্যক্তিগত ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না ইত্যাদি। এসব ধারা অনুসরণ করা হলে ফলাফল পাওয়া যাবে। সন্ত্রাস, গোঁড়ামি, একগুঁয়েমি ইসলাম সমর্থন করে না। সন্ত্রাসী কর্মকা- ও প্রতিশোধ নেয়ার নীতি ইসলাম শিক্ষা দেয়নি। ইসলাম ত্যাগ ও ছাড়ের শিক্ষা দেয়, সবর ও ক্ষমার শিক্ষা দেয়। দেশে বা সমাজে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকা- সংঘটিত হলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করার নীতি শিক্ষা দেয়। সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার পাশাপাশি কেন তা ঘটে তা খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে তা প্রতিরোধের পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ করা সহজ হবে। ইংরেজিতে বলা হয় চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব অর্থাৎ রোগ সারানোর চেয়ে রোগের প্রতিরোধই আগে প্রয়োজন। সন্ত্রাস দূরীকরণে প্রতিরোধমূলক নি¤েœর কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
এক. কৌশলে বুঝানো যেতে পারে। সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের হিংসা না করে বা হুমকি না দিয়ে তাদের উপলব্ধিতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। অপরাধের ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে তাদের মধ্যে অপরাধবিরোধী মানসিকতা গঠন করা যেতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসীরা যে ভুল পথে আছে এ কথা তাদের আন্তরিকতার সাথে বুঝাতে হবে। তাদের দমন করতে গিয়ে এমন কঠোর পন্থা অবলম্বন করা যাবে না, যাতে চরমপন্থা বেড়ে যায়। দুই. প্রথমে মতৈক্যের সূত্র ধরে আলোচনা শুরু করতে হবে। নবী করীম (সা.) পাপাচারীকে চিকিৎসকের দৃষ্টিতে দেখতেন যেমন রোগীকে দেখা হয়। পুলিশের মতো করে তিনি দেখতেন না। অন্ধকারকে অভিশাপ দেয়ার পরিবর্তে আমাদের উচিত রাস্তায় বাতি লাগানোর চেষ্টা করা। তিন. সন্ত্রাস খুবই নিন্দনীয় ও গুরুতর অপরাধ। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার ব্যাপারে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা করেছে। সূরা নিসার ৯৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি জেনেশুনে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে তার শাস্তি জাহান্নাম। চিরদিন সে সেখানে থাকবে। তার প্রতি আল্লাহর গজব ও লা’নত। তার জন্য ভয়াবহ শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। চার. ত্বরিত ফলাফল লাভের চিন্তা কাম্য নয়। আজ ফসল বুনে কালই কাটতে যাওয়া যেমন বোকামি তেমনি সন্ত্রাসীরা দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাবে তেমনটি ভাবাও বোকামি। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কৌশল সহকারে সংশোধনে সচেষ্ট হতে হবে। পরিকল্পনাবিহীন কেবল জীবন কোরবানি করলেই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। পাঁচ. ইসলাম নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন জরুরি। এ প্রসঙ্গে হযরত উমর (রা.) বলেন, আমরা নিকৃষ্ট জাতি ছিলাম। আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন। যদি আমরা ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য পন্থায় সম্মানিত হতে চাই তবে আল্লাহ আমাদের গোড়া কেটে দেবেন। ছয়. ইনসাফ বা ন্যায়বিচারভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কোনো গোষ্ঠীর একজন বা দুজন কোনো অন্যায় করলে সেই গোষ্ঠীর সবার ওপর দোষ চাপানো যাবে না। সূরা আনয়ামের ১৬৪ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না। তাছাড়া ঘটনা ভালো করে না জেনে রায় দেয়ার প্রবণতাও পরিহার করতে হবে। আমাদের কথাবার্তায় ও আচরণে ভারসাম্যপূর্ণ, সুবিবেচক ও উদার হতে হবে। অতিশয়োক্তি বা ত্রাস সৃষ্টিকারী কথা পরিহার করতে হবে। সাত. একগুঁয়েমির দ্বারা এক গুঁয়েমি, গোঁড়ামির দ্বারা গোঁড়ামি এবং অপকর্মের দ্বারা অপকর্মের মোকাবিলা করার পথ পরিহার করতে হবে। সূরা হা-মীম- সিজদার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ভালো ও মন্দ সমান নয়। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করুন। ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে। আট. আইনের দৃষ্টিতে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়নিষ্ঠ বিচার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিই মূলত সন্ত্রাস সৃষ্টির মূল কারণ। নয়. সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তরুণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তাদের মনমানসিকতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করে কথা বলতে হবে। তাদের শুধু দোষ ধরলে চলবে না, তাদের গুণগুলোকে বিকশিত করতে হবে। ইসলামবিরোধী সব কাজের নিষেধ ও প্রয়োজনে বাধা দান করতে হবে। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন বৃহত্তম ফিতনা সৃষ্টি না হয়, মুসলমানদের অযথা রক্তপাত যেন না হয় এবং স্থিতিশীলতা যেন নষ্ট না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ফিতনা বৃদ্ধিকারী প্রতিবাদের চেয়ে নীরবতাই শ্রেয়। অপরাধীদের সৎ ও ভালো মানুষের সাহচর্যে এবং নীতি-নৈতিকতার পরিবেশে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে তাদের চারিত্রিক পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে। দশ. এতসব ফ্যাসিলিটি দেয়ার পরও যদি তারা সংশোধন না হয় তবে তাদের জন্য কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারিত শাস্তি দিতে হবে। জনসমক্ষে শাস্তি দিতে হবে যাতে অন্যায়কারীর মনে ভীতির সঞ্চার হয়। এগার. সন্ত্রাসের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোরও মূলোৎপাটন করতে হবে। জেনা ব্যভিচার, ইভটিজিং, ধর্ষণ, সুদ ঘুষ আদান-প্রদান, চুরি ডাকাতি, জুলুম অত্যাচার নির্যাতন নিষ্পেষণ ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অংশ। এগুলো যারা করে তারা সন্ত্রাসী। দায়িত্বশীলদের এসব অপকর্মকা- বন্ধ করতে হবে। বুখারি শরিফের ২৯৩৯ নং হাদিসে আছে, নবী করীম (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে তার অধীনস্থদের প্রতি অত্যাচার করে। এসব সন্ত্রাসীর শাস্তির ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআন শরিফে যে নীতিমালা দিয়েছেন তা অনুসরণ করা জরুরি। তা না হলে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না।
লেখক : খতিব ও প্রিন্সিপাল

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন