প্রাণঘাতী করোনা মহামারীতে তেল সমৃদ্ধ দেশ ব্রুনাইতে মানবপাচারের শিকার বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। দালাল চক্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এসব প্রবাসী কর্মী তিন থেকে চার লাখ টাকার বিনিময়ে দেশটি গিয়ে কোনো কাজ কর্ম না পেয়ে ঘরবন্দি অবস্থায় অনাহার অনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছে। এসব অসহায় কর্মী গ্রামের বাড়ি থেকে ধার দেনা করে টাকা নিয়ে খাবার কিনে খাচ্ছে। বৈধ ওয়ার্কপারমিট না থাকায় তারা দেশটির কোনো কোম্পানীতে কাজে যোগ দান করতে পারছে না। ফ্লাইট বন্ধ থাকায় তারা দেশেও আসতে পারছে না। দেশটিতে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশটিতে কর্মরত প্রবাসী কর্মীরা ৩৬ দশমিক ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৮ সালে দেশটি থেকে ৪৪ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। ব্রুনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাইকশিনের লেবার উইংয়ের শ্রম সচিব জিলাল হোসেন আজ বৃহস্পতিবার এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ব্রুনাই হাইকমিশনের একটি সূত্র জানায়, ১৯৯২ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে ৭৫ হাজার ২৫০ জন বাংলাদেশি কর্মী চাকরি লাভ করেছে। দেশটিতে ওয়ার্ক ভিসায় গিয়ে অনেকেই অবৈধ ভিসা ট্রেডিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। বেশি বেতনে কাজ দেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দালাল চক্র গ্রামের সহজ সরল কর্মীদের ব্রুনাই নিয়ে অস্বাস্থকর ঘিঞ্জি পরিবেশে আটকে রাখে। কোনো মাসে এক এক প্রজেক্টে ৫ থেকে ৭ দিন কাজ দিলেও বাকি পুরো মাস এসব অসহায় কর্মীদের বেকার আটকে রাখা হয় আবদ্ধ ঘরে। কথা অনুযায়ী কাজ না দেয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানবপাচারকারী দালাল চক্রের হাতে বহু কর্মী নিগৃহীত হয়েছে। আজ ব্রুনাই থেকে প্রতারণার শিকার পাবনার রফিকুল ইসলাম, খুলনার ওমর ফারুক, মোস্তফা, আব্দুল আউয়াল ও সিরাজগঞ্জের কামরুল ইসলাম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের মূল হোতা আব্দুর রহিম,বিজন, গুরু শাহীন, ইলিয়াস, সাইফুল ইসলাম, সোহরাব, কামরুজ্জামান ইঞ্জিনিয়ার, হোসেন বিশ্বাস (বিসি-০৭২৫৭১০), শফিকের মাধ্যমে কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মী প্রতারণার শিকার হয়ে ব্রুনাইতে অনাহার অনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছে। কুখ্যাত দালাল কামরুজ্জামান ইঞ্জিনিয়ার ব্রুনাই থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ার মিরিতে এবং দালাল অপু ফিলিপাইনে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। মানবপাচারকারী চক্রে আরো কিছু হোতা মালয়েশিয়ায় গা ঢাকা দিয়েছে। হাই কমিশনারের ব্যক্তিগত তদারকিতে এ পর্যন্ত দেশটির ৭শ’ অসহায় প্রবাসী কর্মীকে ৫০ ব্রুনাই ডলার করে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে। ব্রুনাই হাই কমিশনের লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা ড. আবু নাঈম আজ বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, গত মাসে ব্রুনাইতে লক্ষীপুর জেলার পশ্চিম নন্দরপুর গ্রামের জাহিদ হোসেনের ছেলে আসিফুল ইসলাম লিমন (২৬) বেরাকাস এলাকার নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সে অবৈধ ভিসা ব্যবসায় জড়িত ছিল। বিয়ের তিন মাস পর সে ব্রুনাইতে চলে যাওয়ার পর তার স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে । এ খবর শুনে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ভিসা দেয়ার কথা বলেও সে গ্রাম থেকে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ব্রুনাই হাইকমিশনের হস্তক্ষেপে মানবপাচারকারীর অনেকেই দেশটি থেকে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়েছে। কুখ্যাত মানবপাচারকারী আব্দুর রহিম গত বছর প্রতারণার শিকার কর্মীদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য পাবনার রফিকুল ইসলামসহ আট জনের বিরুদ্ধে দেশটিতে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। মানবপাচারকারী আব্দুর রহিম দেশটির প্রবাসী ব্যবসায়ী শরীয়তপুরের মো. আতিকের কাছ থেকে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়। পরে ঢাকার সিআইডিতে আতিক মানবপাচারকারী আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
ঢাকার সিআইডি গত ২ মার্চ ব্রুনাইতে মানবপাচার চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পর প্রকাশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, দোহারের জয়পাড়া বটিয়ার মো. জিলহকের পুত্র আব্দুর রহিম, মুন্সিগঞ্জ সদরের নান্নু মাতব্বরের পুত্র শাহিন, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির দোরাবাতি গ্রামের আব্দুর রহিম সর্দারের পুত্র ইসমাইল সর্দার। সম্প্রতি আদালত থেকে মানবপাচারকারীর দু’জন জামিনে মুক্তি পেয়ে মামলার বাদি শরীয়তপুরের মো.আতিককে প্রাণ নাশের হুমকি দিচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন