দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার তেল সমৃদ্ধ দেশ ব্রুনাইতে বাংলাদেশিকর্মী নিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে দেশটিতে চিহ্নিত দালাল চক্রের একটি বড় অংশ এখনো সক্রিয় থাকায় উল্লেখিত শ্রমবাজার নিয়ে আতঙ্ক কমেনি। বৈশ্বিক করোনা মহামারির পর দেশটিতে প্রচুর অভিবাসী কর্মীর চাহিদা রয়েছে। দেশটির সরকার শিগগিরই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী। কিন্ত দেশটির কর্মস্থলে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়াই কর্মী নিতে চায় তারা। ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ প্রবাসী কর্মীদের কাজের গ্যারান্টি, মিনিমাম বেতন কাঠামো প্রণয়ন, কোনো পক্ষ অন্যায় করলে হাইকমিশনের উপস্থিতিতে দ্রুত বিচারসম্পন্ন করার এবং দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের দেয়া সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দিয়েছেন।
দেশটিতে বিগত আড়াই বছর যাবত বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে প্রায় বিশ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। চিহ্নিত দালাল চক্রের প্রতারণা এবং ভিসা ট্রেডিং বন্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন নাহিদা রহমান সুমনা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্রুনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সেলর জিলাল হোসেন এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
লেবার কাউন্সেলর বলেন, ব্রুনাই সরকার রিসিভিং কান্ট্রিগুলো থেকে বিমান ভাড়া দিয়েই কর্মী আনছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্মীদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিমান ভাড়া বহন করতে বলছে। এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, দালাল চক্রের প্রতারণার খপ্পরে পড়ে বহু নিরীহ বাংলাদেশি কমী ব্রুনাই এসে সর্বশান্ত হয়েছে। এখনো দেশটিতে প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই পালিয়ে পালিয়ে কাজ করছে। ভুয়া কোম্পানীর ভিসায় গিয়ে অনেক কর্মীই কোনো কাজ পায়নি। প্রতারণার শিকার অনেক কর্মী পাসপোর্টের অভাবে দেশে ফিরতে পারছে না। তিনি বলেন, তিনজন চিহ্নিত দালালের পাসপোর্ট হাইকমিশন থেকে বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে জসিম সরকার নামের দালাল ইমিগ্রেশনের চোখে ধুলা দিয়ে লন্ডন চলে গেছে। তিনি বলেন, ব্রুনাই থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার সারওয়াক প্রদেশে পাচারকালে আটক হয়ে দেশটির কারাগারে অনেক বাংলাদেশি কর্মী মানবেতর জীবন যাপন করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্রুনাই সরকার করোনা মহামারি থেকে সুরক্ষার জন্য এর মধ্যেই প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে বিনা মূল্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দিয়েছে। তিনি বলেন, অন্য একটি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে দেশটিতে তের সহস্রাধিক বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে।
অতিসম্প্রতি দেশটির সরকার বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বোয়েসেলের মাধ্যমে নতুনভাবে কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের (এমওইউ) জন্য খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে। ব্রুনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে এমওইউ এর প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পর্যালোচনা ও চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী মো. ইমরান আহমদ এমপি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে।
বিএমইটির সূত্র জানায়, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্রুনাইতে ৭৫ হাজার ৪৩৩ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। গতকার বুধবার নেগারা ব্রুনাই দারুসসালাম থেকে নূরশামিয়াহ এসডিএন বিএইচডি’র ম্যানেজার আব্দুল সাত্তার জানান, চলমান লকডাউন তুলে নিলে দেশটিতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে দালাল চক্রের হাতে বহু নিরীহ বাংলাদেশি যুবক প্রতারণার শিকার হয়েছে। এতে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশটিতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলে দেশটির শ্রম আইনানুযায়ী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেই কর্মী পাঠানো উচিৎ। গতকাল বাংলাদেশ হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনার সাথে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, মানবপাচাকারী দালাল চক্র ব্রুনাইতে বেশি বেতনে ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে জনপ্রতি সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশটির বিমান বন্দরে পৌঁছার সাথে সাথে পাসপোর্ট কেঁড়ে নেয়া হতো। মানবপাচারকারী জসিমের বিরুদ্ধে রাজবাড়ী জেলার কালুখালী থানায় প্রতারণার শিকার প্রবাসী কর্মীর অভিভাবকরা মামলা দায়ের করতে গেলে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নাজমূল হাসান মামলা নেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র জানায়, রাজবাড়ী জেলার কালুখালি থানার পশ্চিম হারওয়া গ্রামের মো. আফজাল শেখের ছেলে জুয়েল শেখ ও তার ভাই রুবেল ২০১৭ সালের মাঝামাঝি মাদারিপুরের শিবপুর থানার হযরত আলী বেপারীকান্দি গ্রামের রব মজুমদারের ছেলে প্রতারক জসিমের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দিয়ে ব্রুনাই যায়।
প্রতারক জসিম হাইকমিশনের ভিসা সত্যায়ন ও বিএমইটির বৈধ বর্হিগমন কার্ড ব্যতিরেকে ঢাকা বিমান বন্দর দিয়ে বডি কন্ট্রাক্ট করে ভুয়া স্মার্ট কার্ড দিয়ে জুয়েল শেখ ও তার ভাই রুবেলকে ব্রুনাইতে পাচার করে নিয়ে যায়। অভিযুক্ত জসিমের পরিচালনাধীন ব্রুনাইয়ের রিয়ান এসডিএন বিএইচডি নামক কথিত কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে উল্লেখিত দু’সহোদরকে ব্রুনাই নিয়ে বিমান বন্দরে পৌঁছার পর জসিমের ঘনিষ্ট সহযোগী সাইমউদ্দিন তাদের জসিমের লেবার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সাথেই তাদের পাসপোর্ট কেঁড়ে নেয়। কাজ না দিয়ে ফ্রি ভিসার কর্মী বলে তাদেরকে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়।
ভুক্তভোগী জুয়েল শেখ অভিযুক্ত জসিমকে মাসিক ৫০ ব্রুনাই ডলার করে কমিশন দিতে সম্মত না হওয়ায় জসিম জুয়েলের ভিসা নবায়ন করেনি। ফলে বিগত দু’বছর যাবত জুয়েল শেখ ও তার ভাই রুবেল দেশটিতে অবৈধভাবে অনাহার অনিদ্রায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা গত ২৩ সেপ্টেম্বর মানবপাচারকারী জসিমের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি, সিআইডি, সিআইডি হেডকোয়াটার্স বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করেছেন। প্রতারক জসিম ইমামুল হোসেন সোহাগ নামের বাংলাদেশি যুবককে তুরস্ক পাচার করেছে বলেও হাইকমিশনের লিখিত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। জসিমের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সোহাগ বর্তমানে সার্বিয়ার জেলে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এছাড়া বি-বাড়িয়ার দালাল রফিকের প্রতারণার শিকার ইসরাফিল ব্রুনাইতে পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
রাতে বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমদ চৌধুরী নোমান ইনকিলাবকে বলেন, ব্রুনাই একটি বড় শ্রমবাজার। দীর্ঘদিন যাবত দেশটিতে কর্মী প্রেরণ বন্ধ রয়েছে। উভয় দেশের মাঝে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু বোয়েসেলের মাধ্যমে নয়; সকল রিক্রুটিং এজেন্সি যাতে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে পারে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন