শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অলৌকিক অর্জন

জনসংখ্যা ও বাংলাদেশ : শেষ পর্ব

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

চ্যালেঞ্জ রয়েছে, অপারেশনাল প্ল্যান অনুযায়ী কাজ চলছে : সাহান আরা বানু
এমডিজি’র অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়লেও খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে। ভারসাম্যপূর্ণ জনসংখ্যা গঠনে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহীতারা সুবিধামতো সময়ে সন্তান নিয়ে পরিকল্পিত পরিবার গড়তে পারেন। এতে মা ও শিশুর জীবনের ঝুঁকি ও মৃত্যুহার কমে। পরিবারে আসে আর্থিক সচ্ছলতা। সুন্দর থাকে পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ। কথাগুলো বলেছেন, অর্থনীতিবিদ রবার্ট টমাস ম্যালথাস।

আর এই ভারসাম্যপূর্ণ জনসংখ্যা গঠনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) ২০১৮-এর পরিসংখ্যান মতে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬৫ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন। এই জনগোষ্ঠির মধ্যে ৮ কোটি ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ৭শ’ কর্মক্ষম। যাদের মধ্যে ২৯ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৪ এর মধ্যে। যা মোট জনগোষ্ঠির ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মক্ষম এবং নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির সংখ্যা কম। এই অবস্থা ২০৩০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের দ্রæত উন্নয়ন সম্ভব।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বহুমুখী কর্মকাÐে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার প্রতিদিনই বাড়ছে। জাতিসংঘ ১৯৬৯ সালে পিতামাতার স্বাধীনভাবে সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর ১৯৭৫ সালেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ওই সময়ে সক্ষম দম্পতি প্রায় ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। ২০০০ সালে এই হার বেড়ে ৫৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১১ সালে এর হার ছিল ৬১ দশমিক ২ শতাংশ। তবে বর্তমানে ব্যবহারের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক ১ শতাংশে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের সঙ্গে মোট প্রজনন হারের (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) সম্পর্ক সরাসরি। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাই টিএফআর। ১৯৭৫ সালে নারীরা মোট ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন (টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩)। বর্তমানে টিএফআর ২ দশমিক ০৫ শতাংশ। টার্গেট ২০২১ সালের মধ্যে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা, যা খুব শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বর্তমান ৭৭০ কোটি জনসংখ্যার সঙ্গে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে আরও ২০০ কোটি যোগ হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে মোট জনসংখ্যা ৯৭০ কোটিতে উন্নীত হবে। একই সঙ্গে চলতি শতকের শেষ দিকে বিশ্বের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, যা হবে প্রায় ১১০০ কোটি। নতুন অনুমান অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জনসংখ্যার যে বৃদ্ধি হবে তার অর্ধেকের বেশি হবে নয় দেশ ভারত, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইথিওপিয়া, তাঞ্জানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রে। এ তালিকায় বাংলাদেশ নেই। অথচ স্বাধীনতার পর একদল ম্যালথাসীয় ঘরানার তাত্তি¡ক তো বলেই ফেলেছিলেন যে, বাংলাদেশ একটা ‘পপুলেশন টাইম বোমার’ ওপর বসে রয়েছে। বিষয়টি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অলৌকিক অর্জন হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’ বলেছেন আস্থাশীল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কবির কথা অনুযায়ী, বিশ্ব সত্যিই অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণের যাদু দেখে। আর তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সাফল্যে বিশ্বের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। কিভাবে এই অলৌকিক অর্জন তা কাজে লাগাতে চাচ্ছে বিভিন্ন দেশ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘বার্ষিক গেøাবাল চাইল্ড হুড রিপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গত দুই দশকে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেখানে ভুটানের শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতের ৫৭ শতাংশ। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর ও সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ২৪ বছরে দেশে শিশু মৃত্যুহার ৭৩ শতাংশ কমেছে। এসডিজি অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য থেকে এক মাস বয়সী শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১২ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন।

শিশু মৃত্যু হ্রাসে উন্নতির প্রথম দিকের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ। এটি কমিয়ে আনার সাফল্যকে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) স্বীকৃতি দিয়েছে।
২০১৭ সালে গর্ভকালীন মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৬ থাকলেও বর্তমানে তা ১৭২ জন। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মৃত্যুহার ২০ জন থাকলেও বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১৮ দশমিক ৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রত্যাশিত গড় আয়ুতেও সাফল্য এসেছে। এসভিআরএস’র তথ্য অনুয়ায়ী, ১৯৯১ সালে ছিল ৫৬ দশমিক ১ শতাংশ ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ দশমিক ৩ বছর হয়েছে।

মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। অথচ ১৯৭৪ সালে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৬১ শতাংশ, সেখানে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বর্তমানে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর কোনো দেশ এমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। এমনকি ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’ এ নীতি গ্রহণ করেও বাংলাদেশের মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ইনকিলাবকে বলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নানা পদ্ধতিতে ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ পদ্ধতি ব্যবহারে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছে বিশ্বের কোনো দেশই সেভাবে পারেনি। ফলে সাফল্য এসেছে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে। তবে বাল্যবিবাহ, কিশোরীদের গর্ভবতী হওয়া, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়ানো, ড্রপআউট বন্ধ করাসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু বলেন, সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত একটি মানবাধিকার। প্রতিটি পরিবার পরিকল্পিত হোক, সকল দম্পতি যেন স্বাধীনভাবে সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের ওপর যেন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া না হয়- সেটা তথ্য ও সেবা দিয়ে নিশ্চিত করা হচ্ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক অর্জন থাকলেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যা মোকাবিলায় অপারেশনাল প্ল্যান অনুযায়ী কাজ চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইনকিলাবকে বলেন, সরকার মাতৃ ও শিশু মৃত্যুরোধে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সঠিকভাবে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং ভিটামিন ‘এ’ সম্পূরক ওষুধের সফল ব্যবহার সাফল্যে কাজ করেছে। তিনি বলেন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুরোধে এমডিজি অর্জন করেছি। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রিম্যাচুউরড এ শিশু মৃত্যুহারে লক্ষ্যমাত্রা ১২ দেয়া আছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবাই সঠিকভাবে সঠিক কাজটি করলে এই অপরিণত শিশু মৃত্যুহারের লক্ষ্যমাত্রা আগামী ২ বছরেই অর্জন করা সম্ভব হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন