আফতাব চৌধুরী
পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। ধীরে কমলেও তা উদ্বেগজনক। কারণ এমন এক সময় আসবে যখন বন-জঙ্গলে হয়ত বাঘ পাওয়া যাবেই না। সারা পৃথিবীতে বনের বাঘের সংখ্যা তিন হাজারের নিচে নেমে এসেছে। এই সংখ্যা একশ’ বছর আগে বনে যত বাঘ ছিল তার তিন শতাংশেরও কম। বাঘ নিয়ে প্রাণিবিজ্ঞানীদের উদ্বেগ এ কারণেই বেশি। বাঘের নয়টি উপপ্রজাতি। এরমধ্যে তিনটিই ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
মূলত এশিয়াই ছিল বাঘের প্রধান আবাসস্থল। ককেসাস অঞ্চল থেকে সাইবেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছিল বাঘের বিচরণ ভূমি। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই পশ্চিম এশিয়া থেকে বাঘ নিশ্চিহ্ন হতে শুরু হয়। এখন বাংলাদেশ-ভারত থেকে শুরু করে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বাঘের প্রধান বিচরণ ভূমি আর উত্তরে শুধু সাইবেরিয়ায় বাঘ দেখা যায়। দ্বীপ হিসেবে সুমাত্রায় সবচেয়ে বেশি বাঘ থাকলেও ইন্দোনেশিয়ার অনেক এলাকা থেকে বাঘ নিশ্চিত হয়ে গেছে। এখন বাঘের যে ছয়টি উপপ্রজাতি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যাই বেশি। এই প্রজাতির প্রধান বাসভূমি বাংলাদেশ ও ভারত। নেপাল, ভুটান, মায়ানমার ও দক্ষিণ তিব্বতের কোন কোন অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যায়। এছাড়া ইন্দোচায়নিজ, মালয়, সুমাত্রা, সাইবেরিয়ান সাউথ চায়না টাইগার উপপ্রজাতিও পাওয়া যায়। তবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বালি, জাভা ও অস্পিয়ান টাইগার।
বাঘ রক্ষায় বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সংরক্ষণের জন্য ১৯৭২ সালে জাতীয় বাঘ প্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৭৩ সালে এই প্রকল্প কার্যকর হয়। ১৯৭০-এর দশকে ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১২০০টি। বাঘ প্রকল্পের কল্যাণে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৫০০টিতে। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী সে দেশে ৪০টি বাঘ সংরক্ষণাগার আছে। ব্যাপক সরকারি কর্মকা-ের পরও বাঘ শিকার অবশ্য থেমে নেই। বাঘ শিকারিদের কারণে বর্তমানে সে দেশে বেশ কয়েকটি বাঘ সংরক্ষণাগারে কোনো বাঘই আর অবশিষ্ট নেই। জাতীয় কয়েকটি বাঘ সংরক্ষণ কতৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ সালে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪১৯টিতে। এক দশকে অর্ধেকের বেশি বাঘ কমে গেছে। এরপরও উদ্যোগ থেমে নেই। বাঘ শিকারিদের বিরুদ্ধে কাজ করতে টাইগার প্রটেকশন ফোর্স গঠন করা হয়েছে। সরকার দেদার অর্থের জোগান দিচ্ছে। এ কাজে জড়িয়ে রাখা রয়েছে শত শত গ্রামবাসীকে। আরো নতুন নতুন বাঘ সংরক্ষণাগার স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে দেশের সরকার।
মানুষের শিকারে পরিণত হবার কারণে বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে বাঘ। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে হারে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বাড়ছে তাতে এই শতাব্দীর শেষে সুন্দরবন থেকে হারিয়ে যাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরো কিছু প্রজাতি রক্ষার জন্য গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার কমাতে জরুরি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড ইউএসএ-র প্রধান কর্মকর্তা কলবি লাকস বলেছেন, এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে সুন্দরবনের বাঘ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে বলে আগে বলা হয়েছিল সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চতা বৃদ্ধির হার অনেকটা কম।
বাংলাদেশ, ভারত এবং চীন বাঘের বড় বিচরণ ক্ষেত্র। আবার চীনের মানবসৃষ্ট কারণে বাঘ সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন। তবে অন্যান্য অঞ্চলের মতো চীনেও বাঘ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে ‘সেভ চায়নাস টাইগার’ নামে একটি সংগঠন দেশি-বিদেশি সংস্থার হয়ে কাজ করছে। সেখানেও বাঘ সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হচ্ছে। এমনকি তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঘ পাঠাচ্ছে বংশ বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের জন্য। চীনে বাঘের প্রধান হুমকি সেখানকার প্রচলিত বিশ্বাস। চীনের বহু লোক বিশ্বাস করে যে, বাঘের দেহের বিভিন্ন অংশের ঔষধি গুণ আছে। এ কারণে বহু বাঘ মানুষের শিকারে পরিণত হয়। যদিও এই ঔষধি গুণের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সম্প্রতি চীনের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও বলেছেন, তারা ওষুধ কারখানায় বাঘের হাড় ব্যবহার করবেন না। সরকারিভাবেও ওষুধ কারখানায় বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে বাঘ শিকারের জন্য মৃত্যুদ-েরও বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ীও বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ কেনাবেচা নিষিদ্ধ। ১৯৯৩ সালেই চীন তা নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও সেখানে বাঘের খামার গড়ে তোলা হয়েছে, যা বাঘের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে কাজ করছে। কারণ, দেখা গেছে ওষুধ কারখানায় বাঘের চাহিদার কারণেই সাধারণত এসব খামার স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে।
চাহিদা বাড়লে বন্য বাঘের ওপর আক্রমণও বাড়ে। কারণ বনের বাঘই তাদের কাছে বেশি পছন্দের। এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে বনের বাঘের চেয়ে পালন করা বাঘের সংখ্যা অনেক বেশি। পালন করা বাঘের সংখ্যা ১৩ হাজার। বনে যে পরিমাণ বাঘ আছে তার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে প্রাণী বিক্রির মার্কেটে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চায়না টাইগারের মতো সাইবেরিয়ান টাইগারেরও একই অবস্থা।
১৯৪০-এর দশকে যখন বাঘ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঘ শিকার কঠোরভাবে বন্ধ করে এবং সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তোলে। এর ফলে সেখানে বাঘের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯০-এ আবার বাঘ শিকার বাড়তে থাকে। এখন বন-জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা পাঁচশ’র মতো। প্রচ- হুমকির মুখে থাকা বাঘ সংরক্ষণের আহ্বান জানানোর মধ্যদিয়ে গত মাসে শুরু হয়েছে এবারের চৈনিক বাঘ বর্ষ। বাঘের বর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশও নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। বাঘ শিকার বন্ধ করা ও বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্রও বিলি করা হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঁচাতে ভুটানও নানা উদ্যোগ রিয়েছে। পিছিয়ে নেই রাশিয়াও। রুশ প্রধানমন্ত্রী ভøাদিমির পুতিন সহসাই একটি সম্মেলন আয়োজন করতে চলেছেন। অবশ্য তাঁর বেশি আগ্রহ সাইবেরিয়ান টাইগারের প্রতি। বাঘের অস্তিত্ব সংকটের জন্য মানুষের নানামুখী কর্মকা-ই দায়ী। কেউ ওষুধ তৈরির জন্য বাঘ শিকার করে, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বাঘ শিকারি ও পাচারকারীরা হানা দেয় বাঘের বিচরণ ক্ষেত্রে। জঙ্গল কেটে কৃষি জমি বাড়ানো ও বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীন মনোভাবও এ জন্য দায়ী। আবার কখনো কখনো বাঘ সংরক্ষণবাদীরাও বাঘ সংরক্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ যখন বাঘ শিকারিদের বিরুদ্ধে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত তা না করে তখন তারা অর্থ সংগ্রহে বেশি মনোযোগী হয়। এটি আরো স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায়, গত এক দশকে বাঘ সংরক্ষণের জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার অর্থ ব্যয় করা হলেও বাঘের সংখ্যা নেমে গেছে প্রায় অর্ধেকে।
বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম বিশ্বজুড়ে। এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে অতি প্রিয় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। প্রাণিবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত প্রয়োজনীয় খাবার ও পরিবেশ না থাকায় এবং শিকারিদের ভয়ে সুন্দরবন অঞ্চলের বেশিরভাগ বাঘই ভারতীয় অঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে সরকারের দৃষ্টিদান অতিব জরুরি।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সদস্য বন ও পরিবেশ কমিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন