পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ আপাতত পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাচ্ছে না। তিনি আরো বলেছেন, কোনো দেশের সাথে কূটনৈতিক টানাপড়েন চললে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় না। যুদ্ধের সময়ও সম্পর্ক বজায় থাকে। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, সময়কে বিবেচনায় নিতে হবে, জাতীয় স্বার্থ মাথায় রাখতে হবে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূল্যায়ন করি ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হবে। আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তার বক্তব্যের জন্য মোবারকবাদ জানাই। কারণ কোনো একটি বিষয়ের জের ধরে সম্পর্ক ছিন্নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না এবং তা কাক্সিক্ষতও নয়। বর্তমান বিশ্বে যেখানে এক দেশের সাথে আরেক দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে নানা কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, তখন আমাদের দেশে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদে মহলবিশেষের দাবি প্রকৃতপক্ষে ভারতনির্ভরতার দিকে ঠেলে দেয়ায় শামিল। এই প্রবণতা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। সময় ও ঐতিহাসিক বিচারেই পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক মূল্যায়িত হওয়া যৌক্তিক।
প্রকাশিত খবরাদিতে বলা হয়েছে, ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন খাদের কিনারায় এসে ঠেকেছে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। গত কিছুদিনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলে পাকিস্তানও ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। আবার ঢাকায় পাকিস্তানের কোনো কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ বহিষ্কার করলে পাকিস্তানও ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করছে। ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করলে পাল্টা ব্যবস্থা স্বরূপ ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত সোমবার ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের এক কর্মকর্তাকে আটকের পর ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের এক কর্মকর্তা সাত ঘণ্টা নিখোঁজ ছিলেন। সম্পর্কের টানাপড়েনের বর্তমান পর্যায় শুরু হয়েছে বাংলদেশি কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে। কেন এবং কী কারণে দু’দেশের সম্পর্ক বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তা নিয়েও নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান পরস্পর চিরশত্রু বলে মনে করলেও তাদের সম্পর্ক এখন আমাদের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের চেয়েও ভালো। এর বড় কারণ, কূটনৈতিক উদ্যোগ বা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অনুসরণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্তিযুদ্ধের পরেও পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ বিবেচনায় দেখা হতো। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিবেচনা থেকে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। তার এই কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এড়িয়ে দু’দেশের সম্পর্ক শীতল বা ছিন্ন করা উচিত হবে না। এ কথা সকলেরই মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের অবনতি বা সম্পর্ক ছিন্ন হলে বাংলাদেশ কার্যত সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে ছিটকে পড়বে, যার পরিণতি মঙ্গলজনক হবে না। বর্তমান যুগ কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মধ্য দিয়েই চলছে। সউদী আরবে একজন শিয়া আলেমের মৃত্যুদ- কার্যকর করা নিয়ে দু’দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হলেও ইরান সউদী আরবের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি সউদী দূতাবাসে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে দেশটি। ইরান-আমেরিকা শীতল সম্পর্কের আবসান হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলে বিবেচিত কিউবার সাথে নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। একসময়ে ব্রিটিশরা ভারত দখল করে নিয়েছিল। প্রায় দুশো বছর তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। স্বাধীনতার পর ব্রিটিনের বিরুদ্ধে ভারত বা পাকিস্তানে কোনো ব্যবস্থা, কোনো মামলা হয়নি, বিচারও হয়নি। ব্রিটেনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের কোনো ঘাটতি হয়নি। শুধু ব্রিটিশ ভারতই নয়, ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর স্বাধীন দেশগুলোর সাথে উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। সম্পর্ক উন্নয়নকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
সম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করে একান্তই আন্তরিকতার ওপর। একথা অপ্রিয় হলেও সত্য, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কেউ কেউ রয়েছেন, যারা রাজনীতির কথা উঠলেই পাকিস্তানকে গালি দিতে না পারলে যেন স্বস্তিবোধ করেন না। প্রতিটি দেশের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং তা থাকাটাই স্বাভাবিক। এটা বিশ্বের সব দেশকেই মনে রাখতে হবে, বাংলদেশ একটি স্বাধীন দেশ। এদেশের সিদ্ধান্ত তার একান্তই নিজেদের ব্যাপার। অভিমত প্রকাশ করার অর্থ যেন চাপিয়ে দেয়া না হয়, এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে, সম্পর্ক ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যাতে একা না হয়ে পড়ে। তা হলে এর ঝুঁকি জনগণকেই বহন করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সময় এবং জাতীয় স্বার্থের বিবেচনার যে প্রসঙ্গ তুলেছেন, তাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দু’দেশের কূটনৈতিক বিরোধের মীমাংসা করা হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন