শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

অভিমত : গণতন্ত্র ও আইনের শাসন

প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : মধ্যযুগের ধর্মচিন্তক ও রাষ্ট্রচিন্তকরা মানব কল্যাণে যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন, তা একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেকটাই অনুপস্থিত। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একথাটা খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে মানুষকে স্বপ্ন দেখালেও তা শুধু ফাঁকাবুলি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। স্বপ্নবিলাস বললেও অত্যুক্তি হবার কথা নয়। আমরা ক্রমেই যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। সভ্যতার অবিস্মরণীয় অবদান হচ্ছে কল্যাণমুখী, গণতান্ত্রিক ও গতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু আমরা সে সুবিধাটা পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারিনি। দেশে সুশাসন নিশ্চিতের জন্য সরকার ও সংবিধান থাকলেও আত্মকেন্দ্রীক ও গোষ্ঠীকেন্দ্রীক রাজনীতির কারণে দেশের মানুষ সে সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। ফলে আইন ও সাংবিধানিক শাসন এখন দূরপরাহত।
আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। মূলত আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিকের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। সংবিধানের গণমুখী অনুচ্ছেদগুলো সংবিধানেই লিপিবদ্ধ, বাস্তব প্রয়োগ খুবই গৌণ বলেই প্রতীয়মান। আমাদের দেশে কি সাংবিধানিক শাসন চলছে; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কি উচ্চকিত করা হচ্ছে ? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্রই। আর এর জবাবটাও রীতিমত নেতিবাচক বলে মনে করার কারণ রয়েছে। যারা এখন ক্ষমতা চর্চা করছেন তারা তো সবকিছুই রঙ্গীন ফ্রেমে দেখতেই অভ্যস্ত। তারা মনে করছেন, দেশে সংবিধান আছে, আছে সাংবিধানিক শাসন। এমনকি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
সংবিধানে নাগরিকদের জন্য গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চয়তাসহ মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র কি সে দায়িত্ব যথাযথাভাবে পালন করছে? যারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন তাদের উত্তর নেতিবাচক। আর বাস্তবতাটা হচ্ছে আরও মর্মপীড়াদায়ক। সম্প্রতি তা কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়নে উঠে এসেছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) পর্যবেক্ষণে বলেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মকভাবে আক্রমণের মুখে পড়েছে।Bangladesh : Government Shuts Down Critics শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার বাংলাদেশেবিরোধী মতের লোকজনের কণ্ঠস্বর দমাতে সক্রিয় রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি অভিযোগ করছে, আদালত অবমাননার মামলা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট মামলা দায়ের করার মাধ্যমে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্রমেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মন্তব্য করেছে। সংস্থাটির ভাষায়, নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন মামলা দায়ের করছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ গত বছর কঠিন সময় পার করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক এসব মানবাধিকার সংস্থায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। দেশে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইন ও সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে তাহলে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। সরকার তো ভিন্নমতকে বিভিন্ন অপবিশেষণে বিশেষিত করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এসব সংস্থার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে তারা কিভাবে মোকাবিলা করবে, আর শক্ত ভাষায় গালাগাল দিলেই কি এ সমস্যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে? আসলে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তাসহ সকল সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যদি জননিরাপত্তায় বিঘœ ও গণমানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ ওঠে, তাহলে রাষ্ট্রের কল্যাণের ধারণা অপ্রয়োজনীয় ও অসার হয়ে পড়ে। একথার আরও জোরালো সমর্থন মেলে সিপিডি’র আলোচনা সভার বক্তব্যে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের সময়কালের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হয়েছে। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যবোধ প্রভৃতি অনেক বেশি দেশপ্রেম ঘেঁষা ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
দেশের রাজনীতি ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতকে কোনভাবেই সহ্য করা হচ্ছে না। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করায় ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এই মামলার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু এ মামলায় কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের উপাদান খুঁজে পাওয়া গেল তা মোটেই বোধগম্য নয়। দেশের প্রখ্যাত আইনবিদ ও প্রাজ্ঞজন বেগম জিয়ার বক্তব্যে মধ্যে কোন রাষ্ট্রদ্রোহিতার উপাদান খুঁজে পাচ্ছেন না। দ-বিধির ১২৪-ক ধারায়ও রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কে সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কথিত বা লিখিত শব্দাবলী দ্বারা অথবা সংকেতসমূহ দ্বারা বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তি দ্বারা অথবা প্রকারান্তরে আইনবলে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞার সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ করে অথবা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে’। মূলত দ-বিধিতে এসব অভিপ্রায়কেই রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা বা কোন বিষয়ে সরকারের সাথে দ্বিমত পোষণ রাষ্ট্রদ্রোহীর মধ্যে পড়ে এমনটা বলা হয়নি। দেশের একজন প্রথিতযশা ও প্রবীণ আইনবিদ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাকে ‘পলিটিক্যাল ভিকটিমাইজেন’ বলে উস্মা প্রকাশ করেছেন। যদি তার কথা সঠিক হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক।
জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, সরকার এখন পুরোপুরি গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সংসদের বাইরের বিরোধী দলের তরফে বলা হচ্ছে যে, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন আর সরকারের সমর্থক নয়। তারা এই সরকারের পরিবর্তন চায়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ পথ প্রতিনিয়ত রুদ্ধ করা হচ্ছে। দেশের জনগণ চায় দেশে এমন একটি পরিবেশ সরকার সৃষ্টি করুক যেখানে জনগণ বিনা বাধায় শান্তিপূর্ণভাবে এবং কোনোরূপ সহিংসতা বা জোর জবরদস্তির বাইরে তারা ভোট দিতে পারে। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি নাকি মার্কিন দূতকে বলেছেন, দেশের সিংহভাগ মানুষ বিএনপি তথা বিরোধী দলের সাথে আছে। কিন্তু জনগণ যে তাদের সাথে আছে সেটা প্রকাশ করার মতো রাজনৈতিক পরিবেশ দেশে নাই।
সরকার সম্পর্কে সংসদের বাইরের রাজনৈতিক দল ও জনমনে যে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে তা অপনোদন করা সরকারেরই দায়িত্ব। যেহেতু দাবি করা হচ্ছে যে, সরকার গণবিচ্ছিন্ন, তাই সরকারের উচিত নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ও গণভিত্তি প্রমাণের জন্য একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা।
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে টানাপড়েন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে ঘরে-বাইরে বেশ চাপের মুখেই আছে সরকার। এমনটিই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। কিন্তু সরকার বোধহয় ক্ষমতাকে নিষ্কন্টক রাখতেই এসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। অভিজ্ঞমহলের ধারণা সরকার ক্ষমতাকে অনিরাপদ করে এক পা-ও এগুতো চায় না। মূলত সংকটটা সেখানেই। তবে সম্প্রতি প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি বিরূপ সমালোচনার মুখে নাকি সরকার কিছুটা নমনীয়ভাব প্রদর্শন করছে।
mail@seydmasud.com

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন