এবিসিদ্দিক
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের দশ মাসে পেট্রোবাংলার অধীনস্থ গ্যাস কোম্পানিগুলো মোটা অংকের টাকা মুনাফা করে। মাসিক এমআইএস রিপোর্টে বলা হয়, উল্লিখিত সময়ে পেট্রোবাংলার অধীনস্থ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি বাবদ আয় করে ১০ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। ব্যয় হয় ৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ৬০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। পরিচালনা মুনাফা করা হয় ১ হাজার ৬৯৪ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বিবিধ আয় ১ হাজার ২১৭ কোটি ৪৯ হাজার টাকা। আয়করপূর্ব মুনাফা ২ হাজার ৯১১ কোটি ৯০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। করঅন্তে নিট মুনাফা ২ হাজার ১২৬ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া হয় ৪ হাজার ২৩০ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার টাকা। বরাদ্দ আয়কর ৬৬৪ কোটি ৫০ লাখ ৯২ হাজার টাকা। গ্যাস খাতে সরকারের কোনো লোকসান নেই বরং মোটা অংকের মুনাফা। কোম্পানিগুলো যেমন মুনাফা করছে, তেমনি সরকারের কোষাগারে দিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। তারপরও কেন গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি। আবারো দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব। গড়ে ৮৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের ১৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের। কোম্পানিগুলোর এসব প্রস্তাব নিয়ে আগামী ৭ আগস্ট গণশুনানি শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শুনানি চলবে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত।
বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত (মিটারযুক্ত) প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা। বর্তমানে এর দাম ৭ টাকা। এ ছাড়া গৃহস্থালি কাজে সিঙ্গেল বার্নারের (এক চুলা) দাম ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। দুই চুলায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা। বর্তমানে দুই চুলার জন্য প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হয় ৬৫০ টাকা। গত বছর সেপ্টেম্বরে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের ক্ষেত্রে এক চুলার দাম ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়। দুই চলার ক্ষেত্রে ৪৫০ টাকার স্থলে করা হয় ৬৫০ টাকা। ক্যাপটিভ পাওয়ারে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বিদ্যমান ৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ হিসাবে ক্যাপটিভ বিদ্যুকেন্দ্রে ব্যবহারের গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কোম্পানিগুলোর এ প্রস্তাব কার্যকর হলে পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে তাই শিল্পের সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ২ টাকা ৫৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪১ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ হিসাবে সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে ৭১ শতাংশ। শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৬২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। এ খাতে ব্যবহারের গ্যাসের দাম বিদ্যমান ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯৫ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে চা বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৬ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৫০ পয়সা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি কার্যকর হলে চা বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়বে ৬৩ শতাংশ। এ ছাড়া বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৭২ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার প্রস্তাব করা হয়েছে ১৯ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমানে এ খাতে ব্যবহারের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৩৬ পয়সা। আর সিএনজি ও ফিড গ্যাসের দাম ২৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ সিএনজি ও ফিড গ্যাসের দাম ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব পেয়েছে বিইআরসি।
এদিকে ডিসিসিআই গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ব্যবসার ব্যয় বাড়বে এবং রফতানি বাধাগ্রস্ত হবে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে। ডিসিসিআই মনে করে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির নানামুখী কর্মকা- মেটানোর জন্য শিল্প-কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। তদুপরি সার্বিকভাবে এ মূল্য বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায় ব্যয় আরও বাড়বে। বিকল্প হিসেবে ডিসিসিআই মনে করে, সরকার বিশ্ববাজারে তেলের হ্রাসকৃত মূল্যের সুযোগ গ্রহণ করে তেল আমদানি করে জ্বালানির অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে পারে। গ্যাসের দাম বাড়লে পরিবহন ভাড়া বাড়বে, শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে সেই সাথে বাড়বে উৎপাদিত পণ্যের দাম, বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম।
‘বাড়ানোর আগে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, টাকাটা কোথায় যাবে। গুলশানে ৫০০ টাকার গ্যাসের মূল্য যদি ৫০০০ টাকাও হয় তাতে কারো কিছুই যায় আসবে না, কিন্তু বস্তিতে যদি ১০০ টাকাও বাড়ে তাহলে অনেক সমস্যা হবে। ব্যক্তি পরিবহনে যদি গ্যাসের মূল্য বাড়ে তাহলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যদি গণপরিবহনে গ্যাসের মূল্য বাড়ে সেক্ষেত্রে ভাড়া বাড়বে এবং এর থেকে আরও অনেক কিছুরই মূল্য বাড়তে থাকবে।’ গ্যাসের সংকটের কারণে দেশে বিনিয়োগ নেই, অনেক শিল্প অচল হয়ে পড়ে আছে। প্রায় ৪ শতাধিক বড় শিল্প চালু করা যাচ্ছে না গ্যাস সংকটের কারণে। নতুন সংযোগও তেমন নেই যদিও “চোরাই” সংযোগ চলছে। পেট্রোবাংলার তথ্য হচ্ছে, গত অর্থবছরের ১০ মাসে ১১০টি শিল্পসহ প্রায় ১৮ হাজার সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে সেগুলো চোরাই না বৈধ সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশে শিল্পায়ন তথা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বড় বাধা এখন গ্যাস। উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও সেটা যথেষ্ট নয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে গ্যাসের উৎপাদন ছিল ২০০৭৪ দশমিক ৫০১ মিলিয়ন ঘনফুট, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দাঁড়ায় ২৫২৬৩ দশমিক ৪৫১ মিলিয়ন ঘনফুটে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন তেমন একটা বাড়েনি, বরং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি) বর্তমানে ৫৯ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করছে। অর্থাৎ এখনও বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের বিষয়টি আজো চূড়ান্ত হয়নি, যা প্রায় একদশক আগের সিদ্ধান্ত। বলা হয়েছিল যে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে অতিরিক্ত অর্থাৎ দাম বাড়িয়ে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে তা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা হবে। আর সেই অর্থ দিয়ে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হবে। সেটাও আজ পর্যন্ত হয়নি। অথচ দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন