বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কে এই বুদ্ধিজীবী শাহেদ?

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

তিনি বেসরকারি টিভির বুদ্ধিজীবী! টেলিভিশন খুললেই ভেসে ওঠে তার ছবি। নীতিকথা, ভয়ঙ্কর ধমক, প্রতিপক্ষকে হুমকি, মানবতার কথা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ভূগোল, পৌরনীতি হেন কোনো বিষয় নেই যে সে বিষয়ে তিনি বিজ্ঞ নন। সব বিষয়ে জাতিকে জ্ঞানদান করেন। প্রতিদিন তিন-চারটি টিভিতে টকশো করেন। দেশের বেসরকারি টিভিগুলো টক-শোর নামে বুদ্ধিজীবী তৈরির কারখানা হয়ে গেছে। সে সুযোগ নিয়ে প্রথম দিকে উপস্থাপকদের গাঁটের টাকা খরচ করে টকশোতে অংশ নিতেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে টক-শো’য় নিলে টাকার অংকের পরিমাণ বেড়ে যেত।

পরবর্তীতে তিনি টক-শোতে যান কিন্তু গেস্টের সম্মানির খাম উপস্থাপকের পকেটে গুঁজে দেন। এমনিতেই সরকারি দলের পক্ষে কথাবার্তা বলেন, তারপর প্রেমেন্ট টিভির সঞ্চালক-আয়োজকের পকেটে গুজে দেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে টিভির টক-শো আয়োজকদের কাছে তিনি হয়ে উঠেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টক-শোর অতি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীর নাম মো. শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম। তিনি রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক।

দুই-আড়াই বছর ধরে প্রতিদিন কয়েকটি টিভির টক-শো’তে জাতিকে উপদেশ বর্ষণ করছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর তিনি দেশ বরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেয়েও টিভিগুলোর কাছে হয়ে উঠেন করোনা বিশেষজ্ঞ। রিজেন্ট হাসপাতাল প্রথম বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে করোনা পরীক্ষা করায় তিনিই হয়ে যান করোনার চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ। অথচ রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় র‌্যাবের অভিযানের পর দেশবাসী জানতে পারে তিনি ভয়ঙ্কর প্রতারক। প্রতারণা করে মানুষ ঠকানোই তার পেশা। তিনি ক্ষমতাসীন দলের রথী-মহারথি এবং প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে ৬ বছর আগে লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার সরকারি অনুমোদন নিয়েছেন। করোনা চিকিৎসার নামে ভয়াবহ প্রতারণা মাধ্যমে তিনি কিভাবে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন; কিভাবে সরকারের কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বিল নিয়েছেন তা প্রকাশ করেছে র‌্যাব। প্রতারণার কারণে অসংখ্য মামলার আসামি টিভির হঠাৎ বুদ্ধিজীবী কে এই মো. শাহেদ?

অনুসন্ধানে দেখা যায় শাহেদ একজন পেশাদার প্রতারক। প্রতারণা-চাপাবাজি করেই তার উত্থান। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতারণা মামলায় জেলও খাটেন। রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা প্রচারণা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত দুই ডজন মামলা। লম্পট ও প্রতারকরা সব সময় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। হঠাৎ বুদ্ধিজীবী প্রতারক শাহেদও টিভিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। শুধু করোনা নয়, বিশ্বের হেন কোনো বিষয় নেই যে তিনি জানেন না। প্রতিটি বিষয়ে বিজ্ঞের মতো জ্ঞান দান করতেন; সরকারকে তোষামোদ করতেন।

পলাতক এই ‘হঠাৎ বুদ্ধিজীবী’ শাহেদ করিমের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। তার বাবার নাম মো. করিম। সেখানে তার বাবার ‘করিম সুপার মার্কেট’ নামের একটি বিপণিবিতান ছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শাহেদ সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় চলে আসে। মাঝে মাঝে সাতক্ষীরায় যেত। তার মা সাফিয়া করিম স্থানীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শাহেদের এই উত্থানে এলাকাবাসী হতবাক।

শাহেদ নিজেকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির সদস্য পরিচয় দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির সাধারণ সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেছেন, শাহেদ করিম কমিটির সদস্য নন। তিনি মাঝে মাঝে বৈঠকে আসতেন। আগে কোনো একসময় হয়তো সদস্য ছিলেন। টক-শোতে উপস্থাপক প্রিয় হওয়ায় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায় এবং অপকর্ম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকা প্রকাশ করেন। নিজেকে সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচয় দিতেন। সাতক্ষীরায় তাকে সবাই প্রতারক শাহেদ হিসেবেই চেনে।
সূত্র জানায়, শাহেদ ঝানু প্রতারক। মানুষের চোখে ধুলা দেয়া বা মানুষকে আপন করে নেয়ার কৌঁশলে ছিল সে পটু। দামি গাড়ি ব্যবহার করে নিজেকে ওপর তলার মানুষ হিসেবে জাহির করতেন। শাহেদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য; ন্যাশনাল প্যারা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট; রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি, রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড, রিজেন্ট গ্রæপের চেয়ারম্যান ও সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।

বিভিন্ন সরকারি দফতরে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, উত্তরা মিডিয়া ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতেন। কর্মকর্তা ও নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে ছবি তুলতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এসব কিছু কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই শাহেদ বিভিন্ন অপকর্ম করছেন। তিনি একে একে করিম রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড (মিরপুর), রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড (উত্তরা), ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ, রিজেন্ট ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, হোটেল মিলিনা গড়ে তোলেন। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহেদের অপকর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক। প্রতারণা করাই যার মূল কাজ, সেই ব্যক্তি কীভাবে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন; ছবি তুলে বাঁধিয়ে রাখেন, কিভাবে লাইসেন্স না থাকার পরও করোনা চিকিৎসার জন্য কাজ পেলেন? কীভাবে কথিত বুদ্ধিজীবী সেজে টক-শো’তে অংশগ্রহণ করতেন, তার প্রমোটার কারা এসব নিয়ে চলছে আলোচনা। অনেকেই বলছেন, শাহেদের পিছনে রাঘব- বোয়ালরা রয়েছেন।

করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা ও আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ঘিরে রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার প্রধান আসামি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. শাহেদকে খুঁজছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে তিনি পালিয়ে গেছেন। হঠাৎ বুদ্ধিজীবী শাহেদকে নিয়ে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে তিনি কখনো মো. শাহেদ, কখনো শাহেদ করিম কখনো মেজর, কখনো সচিব, আবার ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করতেন। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ থেকে ৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার নথিতে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে আদালতে দুটি মামলা চলছে।

টিভির টক-শো’র বুদ্ধিজীবী শাহেদের প্রতারণার অভিযোগে ২০০৯ সালে পুলিশ ও র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে। ওই মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, খুলনার একটি টেক্সটাইল মিলের জন্য ২৫টি এসি সরবরাহের কার্যাদেশ পায় শাহেদ করিমের প্রতিষ্ঠান। জিনিসপত্র নিয়ে ১৯ লাখ টাকার চেক দেন রাইজিং শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি এবং রাইজিং রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহেদ করিম। ব্যাংকে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এ ঘটনায় মামলা করে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সালে শাহেদ প্রতারণা মামলায় গ্রেফতার হয়। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই সে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসে।

এদিকে ২০১১ সালে শাহেদ ধানমন্ডিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বহুধাপ বিপণন (এমএলএম) ব্যবসা শুরু করেন। পরে টাকা নিয়ে চম্পট দেন। ওই সময় প্রতারণার শিকার লোকজন তাকে খুঁজতে শুরু করলে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। কয়েক বছর তিনি সপরিবারে ভারতের বারাসাতে ছিলেন। পরে মামলাগুলোয় জামিন পেলে দেশে ফিরে এসে প্রতারণা ব্যবসা শুরু করেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
Md. Younus biswas ৯ জুলাই, ২০২০, ১২:৫৯ এএম says : 0
Dhurandar, batper, protaro, chitar, kholnyok, soitaner chala etc...... Direct shoot crose fire
Total Reply(0)
Bablu Bhuiyan ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৪ এএম says : 0
প্রশাসন চাইলে ভন্ড চেতনাবাজ সাহেদ কে 1 ঘন্টার ভেতরে গ্রেফতার করতে পারে। তবে শেষটা হয়তো শুনতে পাবেন উনি দেশ থেকে পালিয়েছে
Total Reply(0)
ক্ষনিকের মুসাফির ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৫ এএম says : 0
কোন লাভ নাই বড় বড় রুই কাতলা জড়িত মাঝখানে বাংলার সাধারণ মানুষ শেষ। মন্ত্রী এমপিদের জন্য বিদেশে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আছে... এখন থেকে বড় থেকে ছোট্ট পর্যন্ত সবাইকে দেশে চিকিৎসা করাতে হবে বাধ্যতামুলক... তখন দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে...
Total Reply(0)
Kamrul Islam ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৫ এএম says : 0
র‍্যাব ধরলে মিডিয়া বিভিন্ন তথ্য দেয় তার আগে মিডিয়া কি করে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে সব দুর্নীতিবাজ ভালো হয়ে যাবে।
Total Reply(0)
স্বপ্ন বিলাসী সায়েদ ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৬ এএম says : 0
কত পাপিয়া,কত ক্যসিনো সম্রাট , এমপি পাপলু ,কত রিজেন্ট হাসপাতালের চ্যেয়ারম্যান ,কত চাল চোর ,কত তেল চোর যে এই বাঙলার মাটি তে আছে তার হিসাব মনে হয় শয়তানের কাছে ও নেই। যার প্রয়োজন যখন শেষ হয়ে যায় সে তখন ধরা খায়। খোঁজখবর নিলে দেখা যায় সবাই সরকারি দলের নেতাকর্মী।
Total Reply(0)
Anwar Khan ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৬ এএম says : 0
সেতো পার পেয়ে যাবে আওয়ামী লীগের পরিচয় দিয়ে চলত আমার মতে তাকে পেলে কোর্টে না তোলে রেপ প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা
Total Reply(0)
খুরশিদ শাহ ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৬ এএম says : 0
চুরি, ডাকাতি, করোনা সন্ত্রসী, করোনা দূর্নীতি সব ধারায় মামলা হওয়া উচিত ঐ কুলাঙ্গারের বিরুদ্ধে
Total Reply(0)
Asm Al-amin M ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৭ এএম says : 0
এমন কোন অপকর্ম নাই শাহেদ করে নাই আগেকি দেশের প্রশাসন ঘাস কাটছে নাকি কিছুই জানে না
Total Reply(0)
Tahsan Ahmmed ৯ জুলাই, ২০২০, ১:১৭ এএম says : 0
এখনও গ্রেফতার হয় নাই?উনি বিএনপি বা জামাতের বুদ্ধিজীবি হলে এতোক্ষনে গ্রেফতার করা হতো।
Total Reply(0)
jack ali ৯ জুলাই, ২০২০, ১:২২ পিএম says : 0
When governments are criminal then all criminal surround the government and we the general people suffer extremely from head to toe. May Allah install a muslim government who will rule our Beloved country by the Law of Creator Al-Mighty Allah then we will be able to live in our country in peace and also with human dignity...
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন