মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
দেশে যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্মমভাবে খুনের শিকার হচ্ছে নারী। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় ওইসব ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যায়-অবিচার-জুলুমের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে যৌতুকের ভয়াবহতা। একটি সাজানো-গোছানো সুখী পরিবার যৌতুকের কারণে বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। দেশের মধ্যে বিদ্যমান যতগুলো সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে যৌতুক একটি অন্যতম সমস্যা। দেশের জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত হলেও যৌতুকের বিষয়ে সবাই একমত যে যৌতুক দেয়া ও নেয়া একটি জঘণ্যতম অপরাধ। যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। একটা সময় ছিলো যখন মুসলিম নারীরা ছিলো পর্দানশীন। পুরুষের সাথে তাদের দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা, হাসি ঠাট্টা বা গোপনে প্রেম নিবেদনের কোনো সুযোগ ছিলো না। ফলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটি যুবক বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করতো। অভিভাবকেরা ছেলের জন্য উচ্চ শিক্ষিত পাত্রীর চেয়ে ধর্মানুরাগী সুপাত্রীর সন্ধানে ঘটক নিয়োগ করতেন। এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। নতুন প্রজন্মের অনেক শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজের বিয়ের কাজটা নিজেরাই সেরে নিচ্ছে। একটা সময় তো ছেলেমেয়ের সম্মতি থেকে অভিভাবকের সম্মতিই বেশি প্রাধান্য পেত। যে কারণে উভয় পক্ষের অভিভাবকের পছন্দের ভিত্তিতে একটি শুভদিন ধার্য করে শুভ বিবাহ সম্পন্ন হতো। তৎকালীন সময়ে কোনো ছেলে-মেয়ে নিজের ইচ্ছেমত পছন্দ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেও লজ্জাবোধ করতো। অভিভাবকদের সম্মতিতে যাকেই বিয়ে করতো তাকে নিয়েই গড়তো সোনার সংসার। উভয়ের মধ্যে ভালোবাসার সেতু বন্ধন তৈরি হতো নিবিড়ভাবে। দুজনে মিলে হতো এক দেহ, এক মন।
বর্তমানে সর্বনাশা যৌতুক আমাদের সামাজিক, পারিবারিক বন্ধনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অতীতে মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথা না থাকার কারণে মেয়েদের বিয়ে দেয়া ছিল সহজসাধ্য এবং পর্দা প্রথার কঠোরতার কারণে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন ছিলো অকল্পনীয়। বর্তমানে অবৈধ যৌতুক প্রথা বিস্তারের কারণে মেয়েদের জীবনে নির্যাতনের শেষ নেই। পর্দা প্রথার কঠোরতা না থাকার কারণে অবৈধ যৌন সম্পর্কের জঘণ্যতম ঘটনা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে এই অভিশপ্ত যৌতুক প্রথার প্রচলন শুরু হয়েছে হিন্দুদের পণ প্রথা থেকে। হিন্দু বিয়ে বিধান মোতাবেক হিন্দুরা ঘটা করে বরকে যৌতুক দিত। হিন্দু ধর্মে পণ প্রথা আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে এমনি এক কুলীন ব্রাহ্মণের চিত্র এঁকেছেন, অশীতিপর বৃদ্ধ সেই ব্রাহ্মণ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সর্বস্ব বেচা পয়সায় যৌতুকের বিনিময়ে তার দুই যুবতী কন্যাকে একই পিঁড়িতে বিবাহ করেছিলেন। পরভুক ব্রাহ্মণ শ্রেণি শুধু অন্যবর্ণের প্রতি নয় নিজ বর্ণের নারীদের প্রতিও এরকম বৈষম্যমূলক আচরণ উল্লেখিত ঘটনা তারই প্রমাণ। নিকট অতীতে এক কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা তার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে একটি নিম গাছের চারা তুলে দিলেন। সঙ্গে বলে দিলেন তার মেয়েও নিম গাছটির যতœ নিতে। এ ঘটনা কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে যে, রাজস্থানের কোটা জেলার অনগ্রসর গ্রাম ঢাকারখেরিতে ওই ঘটনাটি ঘটেছে। সেখানে একটি বিয়ে সবাইকে বিস্মিত করেছে। যখন কন্যাকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিতে কাড়ি কাড়ি টাকা, গহনাপত্র দিতে হয় সেখানে একজন পিতা তার কন্যা ও নিম গাছের একটি চারা তুলে দিলেন। ওই পিতা তার জামাতা ও তার পরিবারের সদস্যদের আগেই বলে দিয়েছিলেন তার কাছে তার কন্যাও একটি নিম গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। তা-ই তাদের হাতে তুলে দিতে চান তিনি। তা গ্রহণ করতে তাদের অনুরোধ করেন তিনি। তারাও রাজি হয়ে যায়। আয়োজন করা হয় বিয়ের। উল্লেখ্য পাত্রী শকুন্তলা কাবরা ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পাশের জেলা ভিলওয়ারার লাদপুর গ্রামের লক্ষণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। ওই কনে যৌতুককে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে মনে করলেও পিতার কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে একটি গাছ পেয়ে বেজায় খুশি। যৌতুকের অভিশাপ রুখতে শুধু গাছ দিয়ে প্রতিরোধ করলেই যৌতুকের ভয়াবতা থেমে যাবে না। প্রয়োজন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌতুকের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।
অভিশপ্ত যৌতুক প্রথার কারণে কতো দুগ্ধপোষ্য শিশু ইয়াতিম হচ্ছে, কত কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীর জীবন নষ্ট হচ্ছে সে খবর কজনে রাখে। ভাঙছে সোনার সংসার, ধ্বংস হচ্ছে সমাজ, নষ্ট হচ্ছে সম্ভ্রমবোধ, সম্প্রীতি। চারদিকে দাউ দাউ করে জ্বলছে অশান্তির লেলিহান সর্বগ্রাসী অগ্নিশিখা। নিকট অতীতে যৌতুকের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে জয়দেবপুরে জান্নাতুল ফেরদৌস। খবরে প্রকাশ যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পারায় স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির লোকজন তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ রকম ঘটনা অহরহ বাংলাদেশের আনাচে-কানাছে ঘটছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে যৌতুকের লোভে স্ত্রী শামসুন্নাহারকে পিটিয়ে হত্যা করে পাষ- স্বামী। যৌতুকের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে গৃহবধূ আতিয়াকে। নির্মম ও বর্বর ঘটনাটি ঘটেছে গাইবান্ধার মধ্য ফলিয়া গ্রামে, (১১ জুলাই ২০১৬)। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন রাজশাহীর রিফাহ তাসফিয়। মাত্র দেড় বছর হয়েছে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কিন্তু প্রাণের সেই স্বামীর হাতেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হলেন ওই নারী। যৌতুকের জন্য তার হাত-পা পিটিয়ে ভেঙে দেয়া হয়েছে। রাজশাহী নগরের ডিঙ্গাডোবা এলাকায় এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে চিকিৎসাধীন রয়েছে। (১৩ জুলাই ২০১৬)
গরিবের চোখের পানি আমাদের সমাজে বড়ই মূল্যহীন। যৌতুকের বলি থেকে নারীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সর্বস্তরের নাগরিকদের। ইসলামে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধুমাত্র আইন করে যৌতুক প্রথা বন্ধ করা সম্ভব নয়। সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার বাড়ানো হলে যৌতুকের কুপ্রথা থেকে জাতি মুক্তি পেতে পারে। যৌতুকের বোঝা এড়াতে মা-বাবার উচিত মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। যৌতুক সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের দেশে অনেক আইন চালু আছে। এসব আইনের মধ্যে তেমন কোন ত্রুটি আছে বলে আমি মনে করি না। তবে হতাশার কথা হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে অনেক সময় অপরাধীরা আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আইনে বলা আছে, যদি কোন ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করে অথবা প্রদান বা গ্রহণে প্ররোচনা বা উৎসাহ দেয় তা হলে তার পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কারাদ- হতে পারে এবং এক বৎসরের কম নয় এমন কারাদ-ে বা জরিমানায় কিংবা উভয়বিধ দ-ে দ-িত হবেন। যদি কোন ব্যক্তি বর বা কনের পিতামাতা বা অভিভাবকের নিকট হতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন যৌতুক দাবি করে তা হলে তিনি পাঁচ বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য এবং এক বৎসর মেয়াদের কম নয় এমন কারাদ-ে বা জরিমানায় বা উভয়বিধ দ-ে দ-িত হবেন। গোখরো সাপের এক ফোঁটা বিষ যেমন একটি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় ঠিক তেমনি যৌতুকের কুপ্রথা একটি দেশ বা সমাজকে ধ্বংসের ধারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। যৌতুকের অভিশাপ থেকে এই দেশের নারী সমাজকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বত্র ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন