মেঘনার তীব্র ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগর উপজেলার উপকুলীয় সাতটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রাক্ষুসে মেঘনা ইতিমধ্যে গিলে খেয়েছে চরকালকিনি, সাহেবেরহাট, চরফলকন ও পাটারিরহাট ইউনিয়নের ৩৬ ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ওয়ার্ড। ভাঙন ঠেকাতে না পারলে খুব শীঘ্রই পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে আরও ১২টি ওয়ার্ড। এ ছাড়াও ভাঙনের মুখে রয়েছে চরলরেন্স ও চরমার্টিন ইউনিয়ন। রামগতি উপজেলার আসলপাড়া,চরআলগী,রামগতি বাজার, বিবিরহাট ,চরগাজী ইউনিয়নের টাংকি বাজার এলাকার অধিকাংশ এলাকা ইতিমধ্যে নদী গর্বে বিলিন হয়ে গেছে। স্থায়ীভাবে রামগতি- কমলনগর রক্ষার কোন পদক্ষেপ না নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আপদকালীন প্রকল্পের নামে লোপাট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।রামগতি- কমলনগর রক্ষার দাবিতে বিভিন্নস্থানে মানববন্ধন ও সভা-সমাবেশ করে কোন কাজ হচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের নাসিরগঞ্জ বাজারের মেঘনার পাড়ে নিজস্ব উদ্যোগে জংলা বাঁধ দিচ্ছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ইং সালে বৃহত্তর রামগতি উপজেলা থেকে ৫টি ইউনিয়নকে ৯টি ইউনিয়নে বিভক্ত করে কমলনগর উপজেলা সৃষ্টি করা হয়। এর এর অনেক আগ থেকে মেঘনার তীব্র ভাঙন দেখা দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জানা যায়, ১৯৭০ সালের দিকে চরকালকিনি ও চরফলকন ইউনিয়ন দু’টিতে মেঘনার ভাঙন শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ দশকের মেঘনার এ অব্যাহত ভাঙনে চরকালকিনি ইউনিয়নের চরকাঁকড়া, চরসামছুদ্দিন ও তালতলি, সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চরজগবন্ধু, মাতব্বরনগর এবং চরফলকন ইউনিয়নের চরকটোরিয়া, চরকৃষ্ণপুর, মাতব্বরচর ও পাতারচর এবং পাটারীরহাট ইউনিয়নের উরিরচর, পশ্চিম চরফলকন ও ডিএস ফলকনসহ ১২টি গ্রাম সম্পূর্ণ মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গত ৪৯ বছরের ভাঙনে মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়েছে এসব এলাকার প্রায় ২০ হাজার একর ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, আশ্রয়ণ কেন্দ্রের পাঁচটি কলোনি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এবং কয়েক কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়কসহ অসংখ্য মসজিদ, বিভিন্ন স্থাপনা ও হাটবাজার।
সম্প্রতি বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা আরও বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মূখে রয়েছে চরফলকন ইউনিয়নের বাঘারহাট বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স সাহেবেরহাট ইউনিয়নের নতুন কাদিরপন্ডিতেরহাট বাজার, চরকালিকিনি ইউনিয়নের নাসিরগঞ্জ বাজার, চরজগবন্ধু এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও সরকারি বেসরকারি অনেক স্থাপনা। বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তান্ডবলীলা চলতে থাকায় লুধুয়া ফলকন এলাকায় আপদকালীন কাজের অংশ হিসেবে প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ডাম্পিং করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড আপদকালীন চলমান বরাদ্দ দিয়ে জিওব্যাগে ডাম্পিং ও জিও টিউবে ডাম্পিং করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ সব লোক দেখানো আপদকালীন প্রকল্পের নামে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে বলে স্থানীয় মেঘনা পাড়ের মানুষ ক্ষোভ করে জানান।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেঘনার এ ভাঙনরোধে স্থানীয়ভাবে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা যেমন সফল হয়নি; তেমনি সরকারিভাবে নেয়া উদ্যোগও দেখছে না সফলতার মুখ। ২০০৯ সালে প্রথমবার মহাজোট সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট মাহবুবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ‘মেঘনার ভাঙন থেকে রামগতি ও কমলনগরকে রক্ষায় নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির আওতায় ২০১৪ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রথম পর্যায়ের ওই অর্থ দিয়ে কমলনগর উপজেলার মাতব্বরহাট এলাকায় এক কিলোমিটার ও রামগতি উপজেলায় সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকায় ব্লকবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কমলনগর উপজেলার অপর ১২ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত থেকে যায়। ভাঙনের তান্ডবলীলা চলতে থাকায় গেল বর্ষা মৌসুমে লুধুয়া ফলকন এলাকায় আপদকালীন কাজের অংশ হিসেবে প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যায়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতায় তাও নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে নতুন করে আবারও ১কোটি ২৫লক্ষধিক টাকা ব্যায়ে জিও টিউবে ডাম্পিং করা হচ্ছে।
চরকালকিনি ইউনিয়নে নাসিরগঞ্জ বাজারের জংলা বাঁধের উদ্যোক্তা মো. জসিম উদ্দিন জানান, চরকালকিনি ইউনিয়ন ১৯৯৩ইং সন থেকে ভাঙন শুরু হয়। এ পর্যন্ত ভাঙন ঠেকাতো সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। সম্প্রতি ওই ইউনিয়নের নাসিরগঞ্জ বাজারের কিছু অংশ মেঘনার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এ বাজার রক্ষা করা না গেলে উপজেলার চরমার্টিন ও চরলরেন্স ইউনিয়নও নদীভাঙনের কবলে পড়বে। তাই এ এলাকা রক্ষার্থে স্থানীয়দের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে জংলা বাঁধ দেওয়া হচ্ছে।
চরফলকন ইউপি চেয়ারম্যান হাজি হারুনুর রশিদ জানান, অল্প কিছু দিনে মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিলীন হয়ে গেছে। আংশিক বিলীন হয়েছে ৩, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড। যে হারে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে যে কোন মুহুর্তে তার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকার বিলীন হয়ে যেতে পারে। এভাবে ভাঙতে থাকলে তার ইউনিয়ন মেঘনার ভাঙনের কারণে হুমকির মধ্যে রয়েছে
সাহেবেরহাট ইউপি চেয়ারম্যান মাষ্টার মো. আবুল খায়ের জানান, তার ইউনিয়ের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১, ২, ৩, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিলীন হয়ে গেছে বহু আগে। মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে বাকি ৪,৫,৭ ও ৮ নন্বর ওয়ার্ডগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যে কোন মুহূর্ত্বে কমলনগরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে তার ইউনিয়ন।
চরকালকিনি ইউপি চেয়ারম্যান মাষ্টার মো. সাইফুল্লাহ জানান, মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের ৬,৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৪, ৫ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড আংশিক বিলীন হয়ে গেছে। জরুরী কোন পদক্ষেপ না নিলে যে কোন মুহুর্তে ভাঙনে বাকি তিন ওয়ার্ডও মেঘনার গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, মেঘনার ভাঙনরোধে কমলনগর উপজেলার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পে এ অর্থবছরে ৬টি স্পটে প্রায় ১ কোটি ২৫লাক্ষাধিক টাকার জিও টিউবে ডাম্পিং এর কাজ চলছে। ভাঙন ঠেকাতে ভিন্ন কৌশলে কাজের পরিকল্পনা নিচ্ছেন তারা। গেল বছর লুধুয়া এলাকায় ৫ কোটি ৯২ লাখ টাকার প্রকল্পে ১লক্ষ ৮হাজার জিওব্যাগ ফেলে ডাম্পিং করা হয়েছে। অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত ভাঙন কবলিত এলাকায় থেকে কাজ করছি। এখানে অনিয়মের কোন সুয়োগ ছিলোনা । যেহেতু ওই এলাকায় ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হয়নি; তখন মানুষতো বলবেই।”
স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জানান, মেঘনার ভাঙ্গণরোধে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের নতুন ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রনালয় একটু ডিলেমি করার কারণে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এ বছর পাশ করা সম্ভব হয়নি। আশা করছি মেঘনার ভাঙন রোধে আগামী বছর থেকে স্থায়ীভাবে বাঁধের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন