জল্পনা-কল্পনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং কোরবানিবিরোধী অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে দেশের ধর্মপ্রাণ সামর্থ্যবান মুসলমানগণ আত্মত্যাগের আদর্শকে সমুন্নত রেখে ঈদুল আজহা উদযাপন করেছেন। সক্ষমরা অনেকেই পশু কোরবানি করেছেন এবং আনন্দের সাথে দরিদ্র-গরিবদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন। সম্পূর্ণ প্রতিঊল পরিবেশে তাদের আত্মত্যাগের এ উদার মনমানসিকতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। করোনাজনিত পরিস্থিতিতে দেশের এক বিশাল এলাকা মারাত্মক বন্যা কবলিত হওয়া সত্তে¡ও তারা হতাশাগ্রস্ত হননি।
ঈদুলআজহার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে, যারা কোরবানি করতে সক্ষম তারাই কোরবানিযোগ্য পশুর ব্যবস্থা করে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে প্রতিবছরই কোরবানির পশুর হাট বসানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে শহরগুলোতে সরকারিভাবে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার রাজধানীতে এ হাটের সংখ্যা ছিল অনেক কম। করোনা পরিস্থিতির কারণে এ সীমাবদ্ধতায় কোরবানির পশুর হাটগুলোতে পশু ব্যবসায়ীরা যেমন করোনার বিধি-নিষেধগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে সচেষ্ট ছিলেন, তেমনি ক্রেতা সাধারণও বিধি-নিষেধ মেনে চলেছেন। সরকারি বিধিমালা মেনে তারা হাটে-বাজারে অধিক জনসমাবেশ এড়িয়ে চলেছেন। এ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কোরবানির পশু বেচাকেনা হয়েছে, এটি কোরবানির প্রতি তাদের আগ্রহ ও ত্যাগের পরিচয় বহন করে।
দেশে এবার অনলাইনে কোরবানির পশু বেচাকেনা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। করোনার কারণে এ নতুন পদ্ধতিতে বেচাকেনায় অনেকে স্বতস্ফ‚র্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এর ফলে কোরবানির পশুর হাটে গমন করা এবং কোরবানির পশু নিরাপদে গন্তব্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছে। দালাল চক্রের খপ্পর হতেও রক্ষা পাওয়া গিয়েছে। পশুরহাট সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণে থাকায় দালাল চক্রগুলোর অপতৎপরতা তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। যার ফলে কোরবানিদাতারা নিশ্চিন্তে নিরাপদে কোরবানির পশু কিনে কোরবানি করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘করোনা-বন্যা থামাতে পারেনি আনন্দ, ‘ভিন্ন আমেজে ঈদ উদযাপন’ শীর্ষক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এতদসংক্রান্ত চিত্র ও বিবরণ। যাতে বলা হয়েছে,‘আশঙ্কা ছিল বন্যা আর করোনায় ঈদ পালন অনুসঙ্গে ছন্দপতন ঘটাবে। উৎসবের সেই রশনাই বর্ণচ্ছটা হবে ম্রিয়িমাণ। কিন্তু করোনা ও দীর্ঘ বন্যা ঈদে মানুষের উৎসবে ছেদ ফেলতে পারেনি। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর উৎসবের আমেজেই পালিত হয়েছে ঈদুল আজহা।’
বক্তব্যটি যথার্থ। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্র ৭০ দিন পূর্বে করোনাজনিত অতি সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যেই তাদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছিলেন। তখন দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, প্লাবন ছিলনা। ছিল বৈশি^ক করোনা মহামারি, তাতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও ছিল খুবই নগণ্য। দুই ঈদের মাঝখানে করোনা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে এবং ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ রূপে আপতিত হয়েছে বন্যা, যা দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ মানুষকে চরম দুর্ভোগ-দুর্দশায় নিপতিত করেছে, এ হেন পরিস্থিতিতে কোরবানির ঈদ আনন্দ অনেকেরই অনুভব করার কথা নয়। তা সত্তে¡ও ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই কোরবানির ঈদ করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তারা অকাতরে কোরবানির গোশত দুঃখী-দরিদ্রদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। তাদের এ বদান্যতা-দান করোনা-বন্যা ঠেকাতে পারেনি, সে বিষয়টিও স্মরণ করা যেতে পারে।
করোনার কারণে যারা ঢাকা ছেড়ে নিজ গ্রামে বাড়ি যেতে পারেননি, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় কোরবানি দিয়ে গরিব মানুষের মধ্যে গোশত ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। এই দুর্যোগময় করোনার মধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসার সুসংবাদও রয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে ঈদেরদিন গৃহিনীরা নৌকায় রান্না করেছেন এবং বাঁধে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো সেখানেই ভালোমন্দ রান্না করেছে।
প্রতিবেশীদের মধ্যে কোরবানির গোশত বিতরণ করা বাংলাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। এবারের কঠোর করোনা ও মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতিতে যারা কোরবানি করেছেন, তারা অধিক আগ্রহে গরিব প্রতিবেশীদের মধ্যে গোশত ভাগাভাগি করে আনন্দ-উৎসবে তাদের শামিল করেছেন। বিগত ঈদের ন্যায় এবারও ঈদুল আজহার নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করার ওপর বিধি-নিষেধ থাকায় মূলত মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়েছে। অনেক মসজিদের ভিতরে মুসল্লীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায়, বাইরে সড়কে এবং বিল্ডিংয়ের ছাদে নামাজ আদায় করতে হয়েছে। এমনও দেখা গিয়েছে, মসজিদে না গিয়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিজ গৃহে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন এবং কেউ কেউ খোতবা বিহীন নামাজও আদায় করেছেন। করোনার কারণে ঈদোৎসবে, আনন্দে এবং ধর্মীয় অনুভূতি চেতনায় এ মিশ্র প্রতিক্রিয়া এ দেশের মুসলিম জীবনে এক অভিনব অভিজ্ঞতা, যার আত্মপ্রকাশ করোনা মহামারির কারণে। করোনা বিশেষত মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন